শনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

   بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ ﴿

সূরা ফতিহার তাফসির ৷৷ তাফসিরে ইবনে কাসির ৷৷


পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি “ফাতিহা’ শব্দের অর্থ এবং এর বিভিন্ন নাম এ সুরাহ টির নাম ‘সূরাহ্ আল ফাতিহা। কোন কিছু আরম্ভ করার নাম ‘ফাতিহা’ বা উদ্ঘাটিকা। কুর’আনুল কারীমের প্রথমে এই সূরাহ্ টি লিখিত হয়েছে বলে একে ‘সূরাহ্ আল ফাতিহা বলা হয়। তাছাড়া সালাতের মধ্যে এর দ্বারাই কিরা’আত আরম্ভ করা হয় বলেও একে এই নামে অভিহিত করা হয়েছে। উম্মুল কিতাবও এর অপর একটি নাম। জামহূর বা অধিকাংশ ইমামগণ এ মতই পোষণ করে থাকেন। তবে হাসান বাসরী (রহঃ) এবং ইবনু সীরীন (রহঃ) এ কথা স্বীকার করেন না। তাদের মতে লাওহে মাহফূয বা সুরক্ষিত ফলকের নামও উম্মুল কিতাব। হাসান বাসরী (রহঃ) এটাও বলেন যে, আয়াতুল মুহকামাত বা প্রকাশ্য ও স্পষ্ট আয়াতগুলোই উম্মুল কিতাব। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেনঃ الْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ أُمُّ الْقُرْآنِ وَأُمُّ الْكِتَابِ وَالسَّبْعُ الْمَثَانِى والقرآن العظيم. الْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ এই সূরাহ টি হলো উন্মুক্ত কুর’আন, উম্মুল কিতাব, সাব‘আ মাসানী এবং কুর’আনুল ‘আযীম। (হাদীস সহীহ। জামি‘ তিরমিযী ৫/৩১২৪, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন। আবূ দাউদ ২/ ১৪৫৮, দারিমী ২/৪৪৬, মুসনাদ আহমাদ ২/৪৪৮, সনদ সহীহ) এই সুরাহ টির নাম ‘সূরাহ্তুল হামদ’ এবং সূরাতুস সালাতও বটে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহান আল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ “আমি সালাতকে অর্থাৎ সূরাহ্ ফাতিহাকে আমার মধ্যে এবং আমার বান্দাদের মধ্যে অর্ধেক করে ভাগ করে দিয়েছি। যখন বান্দা বলে ﴿اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ﴾ তখন মহান আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে।” (সহীহ মুসলিম ১/৩৮, ২৯২, জামি‘ তিরমিযী ১/২৯৫৩, নাসাঈ ২/৪৭৩, হাঃ ৯০৮, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ১/৩৯, ৮৪, মুসনাদ আহমাদ ২/২৪১, ২৮৫,৪৬০, বায়হাক্বী ২/৩৮, ১৬৭, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ ১/২৫২, হাদীস ৫০২, তাফসীর তাবারী ১/১৪৫, হাদীস ২২১, ২২৪)। এই হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, সূরাহ্ ফাতিহার নাম সূরাহ্ সালাতও বটে। কেননা এই সূরাহ টি সালাতের মধ্যে পাঠ করা আবশ্যক রয়েছে। এই সূরার আরেকটি নাম সূরাহ্তুশ্ শিফা। আবু সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) মারফূ‘ রূপে বর্ণনা করেন যে, সূরাতুল ফাতিহা প্রত্যেক বিশ ক্রিয়ায় আরোগ্যদানকারী। (হাদীস য‘ঈফ। মুসনাদুল ফিরদাউস ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ১৫৭, হাদীস ৪২৬৪, বায়হাক্বী ফি শু‘আবিল ঈমান ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ৪৫০, হাদীস ২৩৬৮, দারিমী ২/৪৪৫, য‘ঈফুল জামি‘ ৩৯৫৪,৩৯৫৫)। এর আরেকটি নাম ‘সূরাহ্তুর রুকিয়্যাহ। আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) সাপে কাটা রুগীর ওপর ফুঁ দিলে সে ভালো হয়ে যায়। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ وَمَا يُدْرِيكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ ‘এটা যে রুকিয়্যাহ অর্থাৎ পড়ে ফুঁক দেয়ার সূরাহ্ তা তুমি কেমন করে জানলে? (ফাতহুল বারী ৪/৫২৯। সহীহুল বুখারী হাঃ ২২৭৬, ৫০০৭, ৫৭৩৬, ৫৭৪৯, সহীহ মুসলিম ৩৯/২৩, হাঃ ২২০১, মুসনাদ আহমাদ হাঃ ১১৩৯৯, আ.প্র. হাঃ ২১১৫, ই.ফা. হাঃ ২১৩২) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) এ সূরাহকে ‘আসাসুল কুর’আন’ অর্থাৎ কুর’আনের মূল বা ভিত্তি বলতেন। আর এই সূরার ভিত্তি হলো بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ। সুফ্ইয়ান ইবনু ‘উয়াইনাহ (রাঃ) বলেন যে, এই সূরার নাম ওয়াফিয়াহ। আর ইয়াহ্ইয়াহ ইবনু কাসীর বলেন, এর নাম কাফিয়াও বটে। কেননা এটা অন্যান্য সূরাহকে বাদ দিয়েও একাই যথেষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু এটাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন সূরাহ যথেষ্ট হয় না। কতিপয় মুরসাল হাদীসেও বর্ণিত আছে যে, উম্মুল কুর’আন সবারই স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। কিন্তু অন্যান্য সূরাহ গুলো উম্মুল কুর’আনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। অত্র সূরাহ কে সূরাতুস সালাত এবং সূরাতুল কানজও বলা হয়েছে। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ (রহঃ) এবং আবুল ‘আলিয়া (রহঃ) বলেন যে, এই সূরাহ টি মাক্কী। কেননা এক আয়াতে আছেঃ ﴿وَ لَقَدْ اٰتَیْنٰكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِیْ وَ الْقُرْاٰنَ الْعَظِیْمَ﴾ “আমি তো তোমাকে দিয়েছি সাত আয়াত যা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয় এবং দিয়েছি মহান কুর’আন।” (সূরা হিজর, আয়াত নং ৮৭) আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভালো জানেন। কুরতুবী (রহঃ) আবু লাইস সমারকান্দী (রহঃ)-এর একটি অভিমত বর্ণনা করেছেন যে, এই সূরাহটির প্রথমাংশ মাক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর শেষ অর্ধাংশ মাদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। তবে হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় এ কথাটিও সম্পূর্ণ গারীব বা দুর্বল। সূরাহ্ ফাতিহায় আয়াত, শব্দ ও অক্ষরের সংখ্যা এ সূরার আয়াত সম্পর্কে সবাই একমত যে এগুলো ৭টি। بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ এ সূরাহ টির পৃথক আয়াত কি-না তাতে মতভেদ রয়েছে। সকল কারী, সাহাবী (রাঃ) এবং তাবি‘ঈ (রহঃ)-এর একটি বিরাট দল এবং পরবর্তী যুগের অনেক বয়োবৃদ্ধ ‘আলিমে দ্বীন একে সূরাহ্ ফাতিহার প্রথম ও পূর্ণ একটি পৃথক আয়াত বলে থাকেন। কেউ কেউ একে সূরাহ ফাতিহারই অংশ বলে মনে করেন। আর কেউ কেউ একে এর প্রথমে মানতে বা স্বীকার করতেই চান না। যেমন মাদীনার ক্বারী ও ফাক্বীহগণ থেকেই এমন মত পরিলক্ষিত হয়। মহান আল্লাহ চাহেতো এর বিস্তারিত বিবরণ সামনে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। এই সূরাহ টির শব্দ হলো পঁচিশটি এবং অক্ষর হলো একশ তেরোটি। সূরাহ্ ফাতিহাকে উম্মুল কিতাব বলার কারণ ইমাম বুখারী (রহঃ) সহীহুল বুখারীর ‘কিতাবুত্ তাফসীরে’ লিখেছেনঃ ‘এই সূরাহ টির নাম উম্মুল কিতাব’ রাখার কারণ এই যে, কুর’আন মাজীদের লিখন এ সূরাহ্ থেকেই আরম্ভ হয়ে থাকে এবং সালাতের কিরা’আতও এ সূরাহ থেকেই শুরু হয়। (ফাতহুল বারী ৮/৬। ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, এটা আবূ ‘উবায়দাহ সর্বপ্রথম অবতারিত সূরাহ কোনটি সর্বপ্রথম সূরাহ্ কোনটি এ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, (১) সূরাহ ফাতিহা হলো সর্বপ্রথম অবতারিত সূরাহ। যেমনটি ইমাম বায়হাকী (রহঃ) ‘দালায়িলুন নাবুওয়্যাত’ এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। আর ‘বাকিল্লানী’ (রহঃ)-এর ও তিনটি উক্তির একটি উক্তি এরূপই। (২) কেউ কেউ বলেন, সর্বপ্রথম অবতারিত সূরাহ হচ্ছে, يا ايها المدثر যেমনটি জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে সহীহুল বুখারী গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। আবার (৩) কেউ কেউ বলেন, সর্বপ্রথম অবতারিত সূরাহ হচ্ছে, اقرأ باسم ربك الذي خلق। (সুনান বায়হাকী, ‘দালায়িলুন নাবুওয়াত’ ৭/১৪৪, তাফসীর তাবারী, ১/৯৪) আর এই সর্বশেষ উক্তিটিই সঠিক। যথাস্থানে এসম্পর্কে অচিরেই বিশদ বিবরণ আসবে। মহান আল্লাহই উত্তম সাহায্যস্থল। সূরাহ্ ফাতিহার গুরুত্ব ও ফাযীলত মুসনাদ আহমাদে আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ ‘আমি সালাত আদায় করছিলাম, এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডাক দিলেন, আমি কোন উত্তর দিলাম না। সালাত শেষ করে আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি আমাকে বললেনঃ এতোক্ষণ তুমি কি কাজ করছিলে?’ আমি বললামঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি সালাত আদায় করছিলাম।’ তিনি বললেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলার এই নির্দেশ কি তুমি শোনোনি? ﴿یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَجِیْبُوْا لِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوْلِ اِذَا دَعَا﴾ “হে মু’মিনগণ! তোমরা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তিনি তোমাদেরকে তোমাদের জীবন সঞ্চারের দিকে আহ্বান করেন।” (৮ নং সূরাহ্ আনফাল, আয়াত নং ২৪) মাসজিদ থেকে যাওয়ার পূর্বেই আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, পবিত্র কুর’আনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সূরাহ্ কোনটি। তারপর তিনি আমার হাত ধরে মাসজিদ থেকে চলে যাবার ইচ্ছা করলে আমি তাঁকে তাঁর অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। তিনি বললেনঃ ‘ঐ সূরাহ টি হলো ‘আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন’। এটাই সাব‘আ মাসানী এবং এটাই কুর’আনুল ‘আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে। (সহীহুল বুখারী, হাঃ ৪২০৪, ৪৪২৬, ৪৭২০, মুসনাদ আহমাদ ৪/২১১, ১৫৭৩, ১৫৭৬৮, ১৭৮৫১, ১৭৮৮৪, সুনান বায়হাকী ২১৩৮, সহীহ ইবনু খুযায়মা, ৮৬২, সুনান নাসাঈ, ২/৯১২, সুনান দারিমী, ২/৩৩৭১, হাদীস সহীহ) এভাবেই এই বর্ণনাটি সহীহুল বুখারী, সুনান আবূ দাঊদ, নাসাঈ এবং ইবনু মাজায়ও অন্য সনদে বর্ণিত হয়েছে। ওয়াকিদী (রহঃ) এই ঘটনাটি উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর বলে উল্লেখ করেছেন। অন্য এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-কে ডাক দিলেন, তখন তিনি সালাতে মগ্ন ছিলেন। সালাত শেষে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে সাক্ষাত করলে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর হাত উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর হাতে রেখে মাসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন আর বলছিলেন, আমার ইচ্ছা যে, তুমি একটি সূরাহ জ্ঞাত না হয়ে মাসজিদ হতে বের হবে না। সূরাটি এমন যে, এর সমতুল্য কোন সূূরাহ তাওরাত, ইনজীল এমন কি স্বয়ং কুর’আন মাজীদেও অবতীর্ন হয়নি। উবাই (রাঃ) বলেন, সূরাটি জানার বাসনায় আমি ধীরে ধীরে চলতে লাগলাম। অতঃপর আমি বললাম, হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! যে সূরাটি জানাতে চেয়েছিলেন তা কোন সূরাহ? তিনি বললেন, তুমি সালাত আরম্ভ করার পর কিরূপে কির’আত পড়ো? উবাই বলেন, আমি সূরাহ ফাতিহা اَلْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ হতে শেষ পর্যন্ত পড়ে শুনালাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, এটাই সেই সূরাহ যে সূরার কথা বলেছিলাম। এ সূরার নামই সাব‘আ মাসানী ও কুর’আনুল ‘আযীম, যা আমাকে প্রদান করা হয়েছে। (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদীস নং ২৭৫) অত্র হাদীসের বর্ণনা কারী আবূ সা‘ঈদ দ্বারা আবূ সা‘ঈদ ইবনু মু‘আল্লা উদ্দেশ্য নয়। যেমনটি জামি‘উল উসূল প্রণেতা ইবনুল আসীর ও তার অনুসারীগণ মনে করেন। আবূ সা‘ঈদ ইবনুল মু‘আল্লা তিনি একজন আনসারী সাহাবী। তার বর্ণিত হাদীস মুত্তাসিল। আর অত্র হাদীসের বর্ণনা কারী আবূ সা‘ঈদ হলেন খুযা‘আ গোত্রের একজন কৃতদাস। তিনি যদি সরাসরি উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর নিকট শোনে না থাকেন তাহলে হবে মুনকাতি‘ বা বিচ্ছিন্ন সূত্র বিশিষ্ট। আর যদি শোনে থাকেন তাহলে ইমাম মুসলিম (রহঃ)-এর শর্তানুযায়ী তা সহীহ হবে। সঠিকটি মহান আল্লাহই ভালো জানেন। তবে হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। মুসনাদ আহমাদে আরো রয়েছে, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর নিকট যান যখন তিনি সালাত আদায় করেছিলেন। তারপর তিনি বলেনঃ ‘হে উবাই (রাঃ)! এতে তিনি তাঁর ডাকের প্রতি মনোযোগ দেন, কিন্তু কোন উত্তর দেননি। আবার তিনি বলেনঃ ‘হে উবাই! তিনি বলেনঃ ‘আস্সালামু ‘আলাইকা।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘ওয়া ‘আলাইকাস সালাম।’ তারপর বলেনঃ ‘হে উবাই! আমি তোমাকে ডাক দিলে উত্তর দাওনি কেন?’ তিনি বলেনঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি সালাত আদায় করছিলাম।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন উপর্যুক্ত আয়াতটিই পাঠ করে বলেনঃ তুমি কি یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَجِیْبُوْا لِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوْلِ اِذَا دَعَاكُمْ لِمَا یُحْیِیْكُمْ এই আয়াতটি শুনোনি? তিনি বলেনঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! হ্যাঁ আমি শুনেছি, এরূপ কাজ আর আমার দ্বারা হবে না।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বললেনঃ তুমি কি চাও যে, তোমাকে আমি এমন একটি সূরার কথা বলি যার মতো কোন সূরাহ্ তাওরাত, ইনজীল এবং কুর’আনেও নেই? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ অবশ্যই বলুন। তিনি বলেনঃ এখান থেকেই যাওয়ার পূর্বেই আমি তোমাকে তা বলে দিবো।’ তারপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার হাত ধরে চলতে চলতে অন্য কথা বলতে থাকেন, আর আমি ধীর গতিতে চলতে থাকি। এই ভয়ে যে না জানি কথা বলা থেকে যায়, আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়ীতে পৌঁছে যান। অবশেষে দরজার নিকট পৌঁছে আমি তাঁকে তাঁর অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেই।’ তিনি বললেনঃ ‘সালাতে কি পাঠ করো? আমি উম্মুল কুরা’ পাঠ করে শুনিয়ে দেই। তিনি বললেনঃ ‘সেই মহান আল্লাহর শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, এরূপ কোন সূরাহ্ তাওরাত, ইনজীল, যাবুরের মধ্যে নেই যা কুর’আনে রয়েছে। এটাই হলো ‘সাব‘আ’ মাসানী। (মুসনাদ আহমাদ ২/৪১২, জামি‘ তিরমিযী ৮/২৮৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫৬০। হাদীস সহীহ) জামি‘উত তিরমিযীতে আরো একটু বেশি বর্ণিত আছে। তা হলো এই যেঃ ‘এটাই মহাগ্রন্থ আল কুর’আন যা আমাকে দান করা হয়েছে।’ এই হাদীসটির সংজ্ঞা ও পরিভাষা অনুযায়ী হাসান ও সহীহ। আনাস (রাঃ) থেকেও এ অধ্যায়ে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। মুসনাদ আহমাদেও এভাবে বর্ণিত আছে। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) একে পরিভাষার প্রেক্ষিতে হাসান গারীব বলে থাকেন। মুসনাদ আহমাদে ‘আবদুল্লাহ ইবনু জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘একবার আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট গমন করি। সে সময় সবেমাত্র তিনি শৌচক্রিয়া সম্পাদন করেছেন। আমি তিনবার সালাম দেই, কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন না। তিনি বাড়ীর মধ্যেই চলে গেলেন। আমি দুঃখিত ও মর্মাহত অবস্থায় মাসজিদে প্রবেশ করি। অল্পক্ষণ পরেই পবিত্র হয়ে তিনি আগমন করেন এবং তিনবার সালামের জবাব দেন। তারপর বলেন, ‘হে ‘আবদুল্লাহ ইবনু জাবির! জেনে রেখো, সম্পূর্ণ কুর’আনের মধ্যে সর্বোত্তম সূরাহ্ হলো اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ এ সূরাহটি। (মুসনাদ আহমাদ ৪/১৭৭, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক - ১/৮৪) এর সনদ খুব চমৎকার। এর বর্ণনাকারী ইবনু ‘আকীলের হাদীস বড় বড় ইমামগণ বর্ণনা করে থাকেন। ইবনুল জাওজী (রহঃ)-এর মতে, এখানে ‘আবদুল্লাহ ইবনু জাবির বলতে আবদী সাহাবীকে বুঝানো হয়েছে। আর হাফিয ইবনু ‘আসাকির (রহঃ)-এর মতে, ইনি হলেন ‘আবদুল্লাহ ইবনু জাবির আনসারী বিয়াযী (রাঃ)। আল কুর’আনের আয়াত, সূরাহ এবং সেগুলোর পারস্পরিক মর্যাদা উপর্যুক্ত হাদীস এবং এর অনুরূপ অন্যান্য হাদীস দ্বারা প্রমাণ বের করে ইসহাক ইবনু রাহ্ওয়াইহ, আবূ বাকর ইবনু ‘আরবী, হাফিয ইবনু হাযার (রহঃ)-সহ অধিকাংশ ‘আলিমগণ বলেছেন যে, কোন কোন আয়াত এবং কোন কোন সূরাহ কিছু আয়াত ও সূরাহ অপেক্ষা বেশি মর্যাদার অধিকারী। আবার কারো কারো মতে মহান আল্লাহর কালাম সবই সমান। একটির ওপর অন্যটির প্রধান্য দিলে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে তা হলো অন্য আয়াত ও সূরাহগুলো কম মর্যাদা সম্পন্ন রূপে পরিগণিত হবে। অথচ মহান আল্লাহর সব কথাই সমমর্যাদাপূর্ণ। (কুরতুবী আশ‘আরী হতে তিনি আবূ বাকর বাকিল্লানী হতে তিনি আবূ হাতিম ইবনু হিব্বান বূসতী হতে তিনি আবূ হিব্বান এবং ইয়াহ্ইয়া ইবনু ইয়াহ্ইয়া হতে এ রকমই বর্ণনা করেছেন) ইমাম মালিক (রহঃ) হতেও এমন হাদীস বর্ণিত আছে। সূরাহ্ ফাতিহার মর্যাদার ব্যাপারে উপরোল্লিখিত হাদীসমূহ ছাড়াও আরো হাদীস রয়েছে। সহীহুল বুখারীতে ‘ফাযায়িলুল কুর’আন’ অধ্যায়ে আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ ‘একবার আমরা সফরে ছিলাম। এক স্থানে আমরা অবতরণ করি। হঠাৎ একটি দাসী এসে বললোঃ ‘এ এলাকার গোত্রের নেতাকে সাপে কেটেছে। আমাদের লোকেরা এখন সবাই অনুপস্থিত। ঝাড় ফুঁক দিতে পারে এমন কেউ আপনাদের মধ্যে আছে কি? আমাদের মধ্য থেকে একটি লোক তার সাথে গেলো। সে যে ঝাড় ফুঁক জানতো তা আমরা জানতাম না। সেখানে গিয়ে সে কিছু ঝাড় ফুঁক করলো। মহান আল্লাহর অপার মহিমায় তৎক্ষণাৎ সে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করলো। তারপর ত্রিশটি ছাগী দিলো এবং আমাদের আতিথেয়তার জন্য অনেক দুধও পাঠিয়ে দিলো। সে ফিরে এলে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ ‘তোমার কি এ বিদ্যা জানা ছিলো? সে বললোঃ ‘আমিতো শুধু সূরাহ্ ফাতিহা পড়ে ফুঁক দিয়েছি।’ আমরা বললামঃ তাহলে এ প্রাপ্ত মাল এখনই স্পর্শ করো না। প্রথমে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করে নেই।’ মাদীনায় এসে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এ ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করলাম। তিনি বললেনঃ وَمَا كَانَ يُدْرِيهِ أَنَّهَا رُقْيَةٌ اقْسِمُوا وَاضْرِبُوا لِي بِسَهْمٍ. ‘এটা যে ফুঁক দেয়ার সূরাহ্ তা সে কি করে জানলো? এ মাল ভাগ করো। আমার জন্যও এক ভাগ রেখো।’ (ফাতহুল বারী ৪/৫২৯। সহীহুল বুখারী হাঃ ২২৭৬, ৫০০৭, ৫৭৩৬, ৫৭৪৯, সহীহ মুসলিম ৩৯/২৩, হাঃ ২২০১, মুসনাদ আহমাদ হাঃ ১১৩৯৯, আ.প্র. হাঃ ২১১৫, ই.ফা. হাঃ ২১৩২) সহীহ মুসলিম ও সুনান নাসাঈতে আছে যে, একবার জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বসেছিলেন, এমন সময় ওপর থেকে এক বিকট শব্দ এলো। জিবরাঈল (আঃ) ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ আজ আকাশের ঐ দরজাটি খুলে গেছে যা ইতোপূর্বে কখনো খুলেনি। তারপর সেখান থেকে একজন ফিরিশতা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে বললেনঃ ‘আপনি খুশি হোন! এমন দু’টি নূর আপনাকে দেয়া হলো যা ইতোপূর্বে কাউকেও দেয়া হয়নি। তা হলো সূরাহ্ ফাতিহা ও সূরাহ্ বাকারার শেষ আয়াতগুলো। এর একেকটি অক্ষরের ওপর নূর রয়েছে।’ এটি সুনান নাসা’ঈর শব্দ। সূরাহ্ ফাতিহা ও সালাত আদায় প্রসঙ্গ সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেনঃ مَنْ صَلَّى صَلاَةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَهْىَ خِدَاجٌ - ثَلاَثًا - غَيْرُ تَمَامٍ গ্ধ. فَقِيلَ لأَبِى هُرَيْرَةَ إِنَّا نَكُونُ وَرَاءَ الإِمَامِ. فَقَالَ اقْرَأْ بِهَا فِى نَفْسِكَ فَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ (রাঃ) يَقُولُ ্র قَالَ اللهُ تَعَالَى قَسَمْتُ الصَّلاَةَ بَيْنِى وَبَيْنَ عَبْدِى نِصْفَيْنِ وَلِعَبْدِى مَا سَأَلَ فَإِذَا قَالَ الْعَبْدُ ( الْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ). قَالَ اللهُ تَعَالَى حَمِدَنِى عَبْدِى وَإِذَا قَالَ (الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ ). قَالَ اللهُ تَعَالَى أَثْنَى عَلَىَّ عَبْدِى. وَإِذَا قَالَ (مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ). قَالَ مَجَّدَنِى عَبْدِى - وَقَالَ مَرَّةً فَوَّضَ إِلَىَّ عَبْدِى - فَإِذَا قَالَ (إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ ). قَالَ هَذَا بَيْنِى وَبَيْنَ عَبْدِى وَلِعَبْدِى مَا سَأَلَ. فَإِذَا قَالَ (اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّينَ ). قَالَ هَذَا لِعَبْدِى وَلِعَبْدِى مَا سَأَلَ. ‘যে ব্যক্তি সালাতে উম্মুল কুর’আন পড়লো না তার সালাত অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, পূর্ণ নয়। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ ‘আমরা যদি ইমামের পিছনে থাকি তাহলে? তিনি বললেনঃ ‘তাহলেও চুপে পড়ে নিয়ো।’ আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে শুনেছি, তিনি বলতেনঃ ‘মহান আল্লাহ ঘোষণা করেনঃ ‘আমি সালাতকে আমার এবং আমার বান্দার মাঝে অর্ধ অর্ধ করে ভাগ করেছি এবং আমার বান্দা আমার কাছে যা চায় তা আমি তাকে দিয়ে থাকি। যখন বান্দা বলে, اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করলো।’ বান্দা যখন বলে اَلرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ তখন মহান আল্লাহ বলেনঃ ‘আমার বান্দা আমার গুণাগুণ বর্ণনা করলো।’ বান্দা যখন বলে, مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘আমার বান্দা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করলো। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তা‘আলা উত্তরে বলেনঃ ‘আমার বান্দা আমার ওপর সবকিছু সর্মপণ করলো।’ যখন বান্দা বলে اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যের কথা এবং আমার বান্দা আমার নিকট যা চাবে আমি তাকে তাই দিবো’ তারপর বান্দা যখন اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ١ۙ۬ۦ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ পাঠ করে তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ‘এসব আমার বান্দার জন্য এবং সে যা কিছু চাইলো তা সবই তার জন্য।’ (সহীহ মুসলিম ১/২৯৬, সুনান নাসাঈ ৫/১১, ১২) কোন কোন হাদীসের বর্ণনায় শব্দগুলোর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। সুনান নাসাঈতে আবূ হুরায়রাহ্ থেকে বর্ণিত, তার অর্ধেক আমার জন্য আর অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা যা চায়, তা তার জন্যই। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) পরিভাষা অনুযায়ী এই হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। কিন্তু আবূ জার‘আ একে সহীহ বলেছেন। মুসনাদ আহমাদেও হাদীসটি বর্ণিত আছে। ইবনু জারীরের এক বর্ণনায় আছে যে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটা আমার জন্য আর যা অবশিষ্ট আছে তা আমার বান্দার জন্য।’ অবশ্য এ হাদীসটি মূলনীতির পরিভাষা অনুসারে দুর্বল। আলোচ্য হাদীস সম্পর্কে আলোচনা এখন এই হাদীসের উপকারিতা ও লাভালাভ লক্ষ্যণীয় বিষয়। প্রথমতঃ এই হাদীসের মধ্যে সালাতের শব্দের সংযোজন রয়েছে এবং তার তাৎপর্য ও ভাবার্থ হচ্ছে কিরা’আত। যেমন কুর’আনের মধ্যে অন্যান্য জায়গায় রয়েছেঃ ﴿وَ لَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَ لَا تُخَافِتْ بِهَا وَ ابْتَغِ بَیْنَ ذٰلِكَ سَبِیْلًا﴾ তোমরা সালাতে তোমাদের স্বর উচু করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না; এই দু’য়ের মধ্য মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো। (সহীহ মুসলিম ১/২৯৬, সুনান নাসাঈ ৫/১১, ১২) এর তাফসীরে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে প্রকাশ্যভাবে বর্ণিত। এখানে ‘সালাত’ শব্দের অর্থ হলো কিরা’আত বা কুর’আন পাঠ। (ফাতহুল বারী ৮/২৫৭) এভাবে উপরোক্ত হাদীসে কিরা’আতকে ‘সালাত’ বলা হয়েছে। এতে সালাতের মধ্যে কিরা’আতের যে গুরুত্ব রয়েছে তা বিলক্ষণ জানা যাচ্ছে। আরো প্রকাশ থাকে যে, কিরা’আত সালাতের একটি বিরাট স্তম্ভ। এ জন্যই এককভাবে ‘ইবাদতের নাম নিয়ে এর একটি অংশ অর্থাৎ কিরা’আতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অপর পক্ষে এমনও হয়েছে যে, এককভাবে কিরা’আতের নাম নিয়ে তার অর্থ সালাত নেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ ﴿وَ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ اِنَّ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْدًا ﴾ কারণ ফজরের কুর’আন পাঠ স্বাক্ষী স্বরূপ। (১৭ নং সূরাহ্ ইসরাহ, আয়াত নং ৭৮) এখানে কুর’আনের ভাবার্থ হলো সালাত। সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসে রয়েছে যে, وَتَجْتَمِعُ مَلَائِكَةُ اللَّيْلِ وَمَلَائِكَةُ النَّهَارِ فِى صَلَاةِ الْفَجْرِ. ‘ফজরের সালাতের সময় রাত ও দিনের ফিরিশতাগণ একত্রিত হোন।’ (সহীহুল বুখারী, ৬২১, সহীহ মুসলিম -১৫০৫, ফাতহুল বারী ৮/২৫১) প্রতি রাক‘আতে সূরাহ্ ফাতিহা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ দ্বারা জানা যায় যে, সালাতে কিরা’আত পাঠ খুবই যরুরী এবং ‘আলিমগণও এ বিষয়ে একমত। দ্বিতীয়তঃ সালাতে সূরাহ ফাতিহা পড়াই যরুরী কি না এবং কুর’আনের মধ্যে হতে কোন কিছু পড়ে নিলেই যথেষ্ঠ কি-না এ ব্যাপারে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) ও তার সহচরবৃন্দের মতে নির্ধারিতভাবে যে সূরাহ ফাতিহাই পড়তে হবে এটা যরুরী নয়। বরং কুর’আনের মধ্য হতে যা কিছু পড়ে নিবে তাই যথেষ্ঠ। তাঁর দালীল হলো- فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآَنِ “কুর’আনের যা সহজ তাই তোমরা পাঠ করো” (৭৩ নং সূরাহ আল মুয্যাম্মিল, আয়াত-২০) আয়াতটি। সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাড়াতাড়ি সালাত আদায়কারী এক ব্যক্তিকে বললেনঃ إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلاَةِ فَكَبِّرْ ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ “যখন তুমি সালাতের জন্য দাঁড়াবে, তখন তাক্বীর বলবে। তারপর কুর’আন থেকে যা তোমার পক্ষে সহজ তা পড়বে।” (সহীহুল বুখারী হাঃ ৭২৪, ৭৫৫, ৭৫৯, ৭৯৩, ৬২৫১, ৬২৫২, ৬৬৬৭ সহীহ মুসলিম ৪/১১, হাঃ ৩৯৭, মুসনাদ আহমাদ হাঃ ৯৬৪১; আ.প্র. হাঃ ৭১৩, ই.ফা. হাঃ ৭২১) তাদের দাবী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লোকটিকে সূরাহ ফাতিহা নির্দিষ্টভাবে পড়ার কথা বললেন না বরং যে কোন কিছই পড়াকে যথেষ্ঠ মনে করলেন। দ্বিতীয় মত এই যে, সালাতে সূরাহ্ ফাতিহা পাঠ করা যরুরী এবং অপরিহার্য এবং তা পড়া ব্যতীত সালাত আদায় হয় না। অন্যান্য সকল ইমামের এটাই অভিমত। ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-সহ তাঁদের ছাত্র এবং জামহূর ‘আলিমগণের এটাই অভিমত। নিম্নের এই হাদীসটি তাঁদের দালীল যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ مَنْ صَلَّى صَلَاةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَهْىَ خِدَاجٌ ‘যে ব্যক্তি সালাত আদায় করলো, অথচ তাতে উম্মুল কুর’আন পাঠ করলো না, ঐ সালাত অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ; পূর্ণ নয়। (সহীহ মুসলিম ৯০৪, সুনান আবূ দাউদ, ৮২১, সুনান তিরমিযী, ৩১২, ২৯৫৩, মুসনাদ আহমাদ ২/২৫০, ৭৮৩২, ৯৯৩২, ১০৩১৯, ২৫০৯৯ সহীহ ইবনু হিব্বান ১৭৮৪, ১৭৯৫, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ ৫১২। হাদীস সহীহ) সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ" ‘যে ব্যক্তি সূরাহ্ ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।’ (ফাতহুল বারী ২/২৭৬, সহীহ মুসলিম ১/২৯৫। [সহীহুল বুখারী হাঃ ১ম ১০৪ পৃষ্ঠা। জুযউল ক্বিরা’আত। সহীহ মুসলিম ১৬৯, ১৭০ পৃষ্ঠা। সুনান আবূ দাঊদ ১০১ পৃষ্ঠা। জামি‘ তিরমিযী ১ম খণ্ড ৫৭,৭১ পৃষ্ঠা। সুনান নাসাঈ ১৪৬ পৃষ্ঠা। ইবনু মাজাহ ৬১ পৃষ্ঠা। মুওয়াত্তা মুহাম্মাদ ৯৫ পৃষ্ঠা। মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ১০৬ পৃষ্ঠা। সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ১ম খণ্ড ২৪৭ পৃষ্ঠা। সহীহ মুসলিম ইসলামিক ফাউণ্ডেশন হাদীস নং ৭৫৮-৭৬৭ ও ৮২০-৮২৪। হাদীস শরীফ, মাওঃ ‘আবদুর রহীম, ২য় খণ্ড ১৯৩-১৯৬ পৃষ্ঠা, ইসলামিয়াত বি-এ. হাদীস পর্ব-১৪৪-১৬১ পৃষ্ঠা। হিদায়াহ দিরায়াহ ১০৬ পৃষ্ঠা। মিশকাত ৭৮ পৃষ্ঠা। সহীহুল বুখারী হাঃ শায়খ ‘আযীযুল হক ১ম খণ্ড হাদীস নং ৪৪১। সহীহুল বুখারী হাঃ- আধুনিক প্রকাশনী ১ম খণ্ড হাদীস নং ৭১২। সহীহুল বুখারী হাঃ- ইসলামিক ফাউণ্ডেশন ২য় খণ্ড হাদীস নং ৭১৮। জামি‘ তিরমিযী- ইসলামিক ফাউণ্ডেশন ১ম খণ্ড হাদীস নং ২৪৭। মিশকাতুল মাসাবীহ- নূর মোহাম্মদ আযমী ২য় খণ্ড ও মাদ্রাসা পাঠ্য হাদীস নং ৭৬৫, ৭৬৬, ৭৯৪। বুলূগুল মারাম ৮৩ পৃষ্ঠা। কিমিয়ায়ে সা‘আদাত ১ম খণ্ড ২০৪ পৃষ্ঠা।] সহীহ মুসলিম ৪/১১, হাঃ ৩৯৪, মুসনাদ আহমাদ হাঃ ২২৮০৭; আ.প্র. হাঃ ৭১২, ই.ফা. হাঃ ৭২০) সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ও সহীহ ইবনু হিব্বানে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ "لَا تُجْزِئُ صَلَاةٌ لَا يُقْرَأُ فِيْهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ" ঐ সালাত হয় না যার মধ্যে উম্মুল কুর’আন পড়া না হয়। (সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্, হাদীস নং ১/২৪৮, ও সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/১৩৯। তবে উম্মুল কিতাব এর স্থলে ফাতিহাতুল কিতাব এসেছে) এ ছাড়া আরো বহু হাদীস রয়েছে যা, প্রতি রাক‘আতে সূরাহ্ ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব হওয়ার প্রতি প্রমাণ করে। বিতর্কের বিষয় আলোচনা করলে আরো লম্বা হয়ে যাবে। আমরা শুধু তাদের বিতর্কের উৎসের দিকে ইঙ্গিত করেছি। (আমাদের দেশে হানাফী মাযহাবের অনুসারী ভাইয়েরা ইমামের পিছনে সূরাহ্ ফাতিহা পাঠ করেন না, এটা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ‘আমলের পরিপন্থী। ইমামের পিছনে মুক্তাদিকে অবশ্যই সূরাহ্ ফাতিহা পাঠ করতে হবে। মুক্তাদী ইমামের পিছনে সূরাহ্ ফাতিহা না পড়লে তার সালাত, সালাত বলে গণ্য হবে না। যেমন মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণীঃ عن عمروبن شعيب عن أبيه عن جده قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تقرؤون خلفي؟ قالوا نعم إنا لنهذ هذا قال فلا تفعلوا إلا بأم القرآن. সহীহুল বুখারীর অন্য বর্ণনায় জুয’উল কিরা’আতের মধ্যে আছে ‘আমর বিন শু‘আইব তাঁর পিতা থেকে, তাঁর পিতা তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন তোমরা কি আমার পিছনে কিছু পড়ে থাকো? তাঁরা বললেন যে, হ্যাঁ আমরা খুব তাড়াহুড়া করে পাঠ করে থাকি। তারপর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন তোমরা উম্মুল কুর’আন অর্থাৎ সূরাহ্ ফাতিহা ব্যতীত কিছুই পড়ো না) উল্লেখ্য যে, ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)-সহ একদল বিদ্বানের মতে প্রত্যেক রাক‘আতে সূরাহ ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব। আবার অন্যেরা বলেছেন, অধিকাংশ রাকা‘আতে পড়া ওয়াজিব। আর হাসান বাসরী (রহঃ)-সহ অধিকাংশ বাসরীদের মত হলো- সালাতের কোন এক রাক‘আতে সূরাহ ফাতিহা পড়ে নেওয়া ওয়াজিব। কেননা হাদীসে মুতলাক তথা সাধারণভাবে সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) তাঁর অনসারীবৃন্দ, সুফইয়ান সাওরী ও আওযা‘ঈ (রহঃ)-এর মতে, সূরাহ ফাতিহা পড়াই নির্দিষ্ট হবে না। বরং অন্য কিছু পড়লেও যথেষ্ট হবে। কেননা মহান আল্লাহ বলেনঃ فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ “কুর’আনের যতোটুকু পড়া তোমার জন্য সহজ হয়, তুমি ততোটুকু পড়ো।” (৭৩ নং সূরাহ আল মুয্যাম্মিল, আয়াত ২০) যেমনটি পূর্বে আলোচনা হয়েছে। মহান আল্লাহ সঠিকটি ভালো জানেন। আর ইবনু মাজাতে বর্ণিত হয়েছে যে, لا صلاة لمن لم يقرأ في كل ركعة بالحمد وسورة في فريضة أو غيرها “যে ব্যক্তি ফরয ইত্যাদি সালাতে সূরাহ ফাতিহা এবং অন্য সূরাহ পড়লো না তার সালাত হলো না। এ হাদীসের বিশুদ্ধতার ব্যাপারে গবেষণার প্রয়োজন আছে। উল্লেখ্য এসব বিস্তারিত আলোচনার জন্য শারী‘আতের আহকামের বড় বড় গ্রন্থ থেকে রয়েছে। মহান আল্লাহ সঠিকটি ভালো জানেন। তৃতীয়তঃ মুক্তাদীগণের সূরাহ ফাতিহা পাঠ করতে হবে কি-না এ ব্যাপারে ‘আলিমগণ থেকে তিনটি অভিমত পাওয়া যায়। যথা- ১. পূর্ববর্তী হাদীসসমূহের ব্যাপকতার কারণে সূরাহ ফাতিহা পাঠ করা মুক্তাদীগণের ওপর তেমনি ওয়াজিব যেমন ইমামের ওপর ওয়াজিব। ২. জেহেরী বা সিররী কোন সালাতেই সূরাহ ফাতিহা বা অন্য কোন সূরাহ কোনক্রমেই ওয়াজিব নয়। সূরাহ ফাতিহাও নয় এবং অন্য সূরাহও নয়। তাদের দালীল মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَتُهُ لَهُ قِرَاءَةٌ. ‘যার জন্য ইমাম রয়েছে, ইমামের ক্বিরা’আতই তার ক্বিরা’আত’। (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৩/৩৩৯, বায়হাকী, ২/১৬০,১৬১, কিন্তু কোনটাই দুর্বলতা মুক্ত নয়। আল মাজমা‘, ২/১১১, আল আওসাত লিত তাবারানী, তবে উক্ত সনদে আবূ হারূন আল আবদী নামের একজন মাতরূক তথা বর্জনীয় রাবী আছে। এ ভাবে অনেকই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন কিন্তু সেগুলোর কোনটাই সহীহ না হওয়ার কারণে এবং রাবীগণ বিভিন্ন দোষে সমালোচিত হওয়ায় সবগুলো বর্ণনাই য‘ঈফ, যেমনটি ইমাম ইবনু কাসীরও বলেছেন) কিন্তু বর্ণনাটি হাদীসের পরিভাষায় একান্ত দুর্বল। যদিও হাদীসটির অন্যান্য সনদও রয়েছে, কিন্তু কোন সনদই অভ্রান্ত ও সঠিক নয়। মহান আল্লাহই ভালো জানেন। যে সালাতে ইমাম নিরবে ক্বিরা’আত পড়েন, তাতে তো মুক্তাদির ওপর ক্বিরা’আত পাঠ ওয়াজিব, কিন্তু যে সালাতে উচ্চ স্বরে ক্বিরা’আত পড়া হয়, তাতে ওয়াজিব নয়। তাদের দালীল হচ্ছে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِنَّمَا جُعِلَ الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا. অনুসরণ করার জন্য ইমাম নির্ধারণ করা হয়েছে। অতএব যখন ইমাম তাকবীর বলে, তোমরা তাকবীর বলো। আর যখন ক্বিরা’আত পড়ে, তখন চুপ থাকো। (সহীহ মুসলিম হাঃ ৯৬২, ৯৩২) এরূপই সুনান কিতাবের রচয়িতাগণও আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে তিনি নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেছেন। মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আর যখন ক্বিরা’আত পড়ে, তখন চুপ থাকো। (সুনান আবূ দাউদ, জামি‘ তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবনু মাজাহ, হাদীস সহীহ) ইমাম মুসলিম ইবনু হাজ্জাজ (রহঃ) হাদীসটি সহীহ বলেছেন। অতএব উপরোক্ত হাদীসদ্বয় তৃতীয় এই মতটির বিশুদ্ধতার প্রতি প্রমাণ বহন করে। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)-এর দু’টি উক্তির পুরাতন উক্তি এটাই। ইমাম আহমাদ (রহঃ) থেকে এরূপ বর্ণনা রয়েছে। এসব মাসা’আলা এখানে বর্ণনা করার মাধ্যমে আমাদের উদ্দেশ্য হলো, সূরাহ ফাতিহার সাথে শারী‘আতের নির্দেশাবলীর যতোটা সম্পর্ক রয়েছে, অন্য কোন সূরার সাথে ততোটা নেই। মুসনাদ বাযযারে আছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ إذا وضعت جنبك على الفراش، وقرأت فاتحة الكتاب و قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ فقد أمنت من كل شيء إلا الموت যখন তোমরা বিছানায় শয়ন করো তখন যদি সূরাহ ফাতিহা এবং সূরাহ ইখলাস পড়ে নাও, তাহলে মৃত্যু ছাড়া প্রত্যেক জিনিস হতে নিরাপদ থাকবে। (মুসনাদ বাযযার, হাদীস-৭৩৯৩। মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ ১৭০৩০, কানযুল ‘উম্মাল ৪১২৬৯ হাদীস যঈফ) ইসতি ‘আযাহ বা আ‘ঊযুবিল্লাহ প্রসঙ্গ পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ ﴿خُذِ الْعَفْوَ وَ اْمُرْ بِالْعُرْفِ وَ اَعْرِضْ عَنِ الْجٰهِلِیْنَ. وَ اِمَّا یَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّیْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ اِنَّه سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ﴾ তুমি বিনয় ক্ষমা পরায়ণতার নীতি গ্রহণ করো এবং লোকদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দাও, আর মূর্খদেরকে এড়িয়ে চলো। শায়তানের কু-মন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে তুমি মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (৭ নং সূরাহ্ আ‘রাফ আয়াত নং ১৯৯-২০০) অন্যত্র মহান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেনঃ ﴿اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ السَّیِّئَةَ١ؕ نَحْنُ اَعْلَمُ بِمَا یَصِفُوْنَ۝۹۶ وَ قُلْ رَّبِّ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزٰتِ الشَّیٰطِیْنِۙ۝۹۷ وَ اَعُوْذُ بِكَ رَبِّ اَنْ یَّحْضُرُوْنِ﴾ মন্দের মুকাবিলা করো উত্তম দ্বারা, তারা যা বলে আমি সে সম্বন্ধে সবিশেষে অবহিত। আর বলোঃ হে আমার রাব্ব! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি শায়তানের প্ররোচনা হতে। হে আমার রাব্ব! আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট ওদের উপস্থিত হতে। (২৩ নং সূরাহ্ মু’মিনূন, আয়াত নং ৯৬-৯৮) অন্য এক জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ ﴿اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ فَاِذَا الَّذِیْ بَیْنَكَ وَ بَیْنَه عَدَاوَةٌ كَاَنَّه وَلِیٌّ حَمِیْمٌ. وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا الَّذِیْنَ صَبَرُوْاۚ وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا ذُوْ حَظٍّ عَظِیْمٍ. وَ اِمَّا یَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّیْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ اِنَّه هُوَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ﴾ মন্দকে প্রতিহত করো উৎকৃষ্ট দ্বারা, ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল, এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকেই যারা মহাভাগ্যবান। যদি শায়তানের কু-মন্ত্রনা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে মহান আল্লাহকে স্মরণ করবে; তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (৪১ নং সূরাহ্ হা-মীম সাজদাহ্, আয়াত নং ৩৪-৩৬) এই মর্মে এই তিনটি আয়াত আছে এবং এই অর্থের অন্য কোন আয়াত নেই। আল্লাহ তা‘আলা এই আয়াতসমূহের মাধ্যমে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, মানুষের শত্রুতার সবচেয়ে ভালো ঔষধ হলো প্রতিদানে তাদের সাথে সৎ ব্যবহার করা। এরূপ করলে তারা তখন শত্রুতা করা থেকেই বিরত থাকবেন না, বরং অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হবে। আর শায়তানদের শত্রুতা হতে নিরাপত্তার জন্য মহান আল্লাহ তাঁরই নিকট আশ্রয় চাইতে বলেন। কারণ সে মানুষের বিনাশ ও ধ্বংসের মধ্যে আনন্দ পায়। তার পুরাতন শত্রুতা আদম (আঃ)-এর সময় থেকেই অব্যাহত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেনঃ ﴿ یٰبَنِیْۤ اٰدَمَ لَا یَفْتِنَنَّكُمُ الشَّیْطٰنُ كَمَاۤ اَخْرَجَ اَبَوَیْكُمْ مِّنَ الْجَنَّةِ﴾ হে আদম সন্তান! শায়তান যেন তোমাদেরকে সেরূপ প্রলুব্ধ করতে না পারে যেরূপ তোমাদের মাতা-পিতাকে প্রলুব্ধ করে জান্নাত থেকে বহিস্কার করেছিলো। (৭ নং সূরাহ্ আ‘রাফ, আয়াত নং ২৭) অন্য স্থানে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ ﴿اِنَّ الشَّیْطٰنَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوْهُ عَدُوًّا اِنَّمَا یَدْعُوْا حِزْبَه لِیَكُوْنُوْا مِنْ اَصْحٰبِ السَّعِیْرِ﴾ শায়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করো। সে তো তার দলবলকে আহ্বান করে শুধু এ জন্য যে, তারা যেন জাহান্নামের সাথী হয়। (৩৫ নং সূরাহ্ ফাতির, আয়াত নং ৬) , মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ ﴿اَفَتَتَّخِذُوْنَه وَ ذُرِّیَّتَهۤ اَوْلِیَآءَ مِنْ دُوْنِیْ وَ هُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظّٰلِمِیْنَ بَدَلًا﴾ তাহলে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে ও তার বংশধরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করেছে? তারা তো তোমাদের শত্রু; সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য রয়েছে কতো নিকৃষ্ট বদলা। (১৮ নং সূরাহ্ কাহফ, আয়াত নং ৫০) এতো সে শায়তান যে আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ)-কে বলেছিলোঃ ‘আমি তোমার একান্ত শুভাকাক্সক্ষী।’ তাহলে চিন্তার বিষয় এই যে, আমাদের সাথে তার চলাচলে কি হতে পারে? আমাদের জন্যই তো শপথ করে বলেছিলো। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿قَالَ فَبِعِزَّتِكَ لَاُغْوِیَنَّهُمْ اَجْمَعِیْنَۙ اِلَّا عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِیْنَ﴾ সে বললোঃ আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করবো। তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দাদেরকে নয়। এ জন্য মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿ فَاِذَا قَرَاْتَ الْقُرْاٰنَ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّیْطٰنِ الرَّجِیْمِ. اِنَّه لَیْسَ لَه سُلْطٰنٌ عَلَى الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَلٰى رَبِّهِمْ یَتَوَكَّلُوْنَ. اِنَّمَا سُلْطٰنُه عَلَى الَّذِیْنَ یَتَوَلَّوْنَه وَ الَّذِیْنَ هُمْ بِه مُشْرِكُوْنَ﴾ যখন তুমি কুর’আন পাঠ করবে তখন অভিশপ্ত শায়তান থেকে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করবে। তার কোন আধিপত্য নেই তাদের ওপর যারা ঈমান আনে ও তাদের রবের ওপর নির্ভর করে। তার আধিপত্য শুধু তাদেরই ওপর যারা তাকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে এবং যারা মহান আল্লাহর সাথে শরীক করে। ঈমানদারগণ ও প্রভুর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের ওপর তার কোন ক্ষমতা নেই। তার ক্ষমতা তো শুধু তাদের ওপরই রয়েছে যারা তার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আল্লাহ তা‘আলার সাথে শিরক করে। (সূরাহ নাহল, আয়াত-৯৮-১০০) কুর’আন তিলাওয়াত করার পূর্বে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ ﴿ فَاِذَا قَرَاْتَ الْقُرْاٰنَ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّیْطٰنِ الرَّجِیْمِ﴾ যখন তুমি কুর’আন পাঠ করবে তখন অভিশপ্ত শায়তান থেকে মহান আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করবে। (১৬ নং সূরাহ্ নাহল, আয়াত নং ৯৮) ক্বারীদের একটি দল ও অন্যেরা উল্লিখিত আয়াতের ভিত্তিতে বলে থাকেন যে, (১) কুর’আন পাঠের পর أَعُوذُ بِاللهِ পড়া কর্তব্য। এতে দু’টি উপকার আছেঃ একঃ কুর’আনের বর্ণনারীতির ওপর ‘আমল এবং দুইঃ ‘ইবাদত শেষে অহঙ্কার দমন। আবুল হাতিম সিজিসতানী এবং ইবনু কালুকা হামযার এই নীতিই নকল করেছেন। যেমন আবুল কাসিম ইউসুফ ইবনু ‘আলী ইবনু জানাদাহ (রহঃ) স্বীয় কিতাব ‘আল ‘ইবাদাতুল কামিল’ এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকেও এটা বর্ণিত আছে। কিন্তু হাদীসের পরিভাষায় এর সনদ গারীব। ইমাম রাযী (রহঃ) স্বীয় তাফসীরের মধ্যে এটা নকল করেছেন এবং বলেছেন যে, ইবরাহীম নাখ্‘ঈ ও দাউদ যাহিরী (রহঃ)-এর এই অভিমত। (২) ইমাম মালিক (রহঃ)-এর মত হলো, ‘সূরাহ ফাতিহার পর পাঠক أَعُوذُ بِاللهِ বলবে। (তাফসীরে কুরতুবী) তবে ইবনুল ‘আরবী এই মতটিকে গারীব বলে আখ্যায়িত করেছেন। (৩) ইমাম রাযী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, উভয় দালীলের ওপর ‘আমলের উদ্দেশ্যে প্রথমে ও শেষে দুইবারই أَعُوذُ بِاللهِ পড়া কর্তব্য। (তাফসীরে কাবীর ১/৫৭, ৫৮) (৪) জামহূর ‘উলামার প্রসিদ্ধ অভিমত এই যে, কুর’আন পাঠের পূর্বে আ‘ঊযুবিল্লাহ’ পাঠ করা উচিত, তাহলে কু-মন্ত্রনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। সুতরাং ঐ ‘আলিমগণের নিকট আয়াতের অর্থ হচ্ছেঃ ‘যখন তুমি পড়বে’ অর্থাৎ তুমি পড়ার ইচ্ছা করবে। যেমন নিম্নের আয়াতটিঃ ﴿اِذَا قُمْتُمْ اِلَى الصَّلٰوةِ ﴾ ‘যখন তুমি সালাত আদায় করার জন্য দাঁড়াও।’ (৫ নং সূরাহ্ মায়িদাহ, আয়াত নং ৬) তাহলে ওযূ করে নাও এর অর্থ হলোঃ ‘যখন তুমি সালাতে দাঁড়ানোর ইচ্ছা করো।’ হাদীসগুলোর ধারা অনুসারেও এই অর্থটিই সঠিক বলে মনে হয়। মুসনাদ আহমাদের হাদীসে আছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতের জন্য দাঁড়াতেন তখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে সালাত আরম্ভ করতেন, অতঃপর سُبْحَانَكَ اَللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ. তিনবার পড়ে لَا إِلَهَ إِلَّا الله পড়তেন। তারপর পড়তেনঃ أَعُوذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ مِنْ هَمْزِهِ ونَفْخِهِ ونَفْثِهِ. চার সুনান গ্রন্থে এ হাদীসটি রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন যে, এই অধ্যায়ে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হাদীস এটাই। (সুনান আবূ দাঊদ ১/৭৭৫, জামি‘ তিরমিযী, ২/২৪২, সুনান নাসাঈ ২/১৩২, ইবনু মাজাহ ১/৮০৭, মুসনাদ আহমাদ ১/৪০৩, ৪০৪, ৪/ ৮০, ৮১, ৮৩, ৮৫, ৬/১৫৬, দারিমী ১/১২৩৯, । হাদীস সহীহ) هَمَزٌ শব্দের অর্থ হলো গলা টিপে ধরা, نَفَخٌ শব্দের অর্থ হলো অহঙ্কার এবং نَفَثٌ শব্দের অর্থ হলো কবিতা আবৃত্তি। ইমাম ইবনু মাজাহ (রহঃ) স্বীয় সুনানে এই অর্থ বর্ণনা করেছেন। (সুনান ইবনু মাজাহ ১/২৬৫) আবূ দাঊদে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতে প্রবেশ করেই তিনবার ‘আল্লাহু আকবার’ কাবীরা’ তিনবার ‘আলহামদুলিল্লাহ কাসীরা’ এবং তিনবার ‘সুবহানাল্লাহি বুকরাতাও ওয়া ওয়াসিলাহ’ পাঠ করতেন। তারপর পড়তেন اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُبِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرّجِيْمِ مِنْ هَمْزه ونَفْخه ونفْثه। (সুনান আবূ দাঊদ ১/৪৮৬, ৭৪৮, হাদীস সহীহ) সুনান ইবনু মাজায়ও অন্য সনদে এই হাদীসটি সংক্ষিপ্তভাবে এসেছে। (সুনান ইবনু মাজাহ- হাদীস নং ১/৮০৮, হাদীস সহীহ) মুসনাদ আহমাদের হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনবার তাকবীর বলতেন। অতঃপর তিনবার سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ বলতেন। অতঃপর أَعُوذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرّجِيْمِ مِنْ هَمْزه ونَفْخه ونفْثه পড়তেন। (মুসনাদ আহমাদ, ৫/২৫৩) রাগান্বিত হলে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে হবে মুসনাদ আবি ই‘য়ালায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে দু’টি লোকের ঝগড়া বেধে যায়। ক্রোধে একজনের নাসাবন্ধ্র ফুলে উঠে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘লোকটি যদি أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়ে নেয়, তাহলে তার ক্রোধ এখনই ঠাণ্ডা ও স্তিমিত হয়ে যাবে।’ ইমাম নাসাঈ (রহঃ) স্বীয় কিতাব أَلْيَوْمُ وَاللَّيْلَةُ-এর মধ্যেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (হাদীস সহীহ। পৃষ্ঠা নং ৩০৬/৩৯১। সুনান আবূ দাউদ ৪/৪৭৮০, জামি‘উত তিরমিযী ৫/৩৪৫২, আল ইয়াওমু ওয়াল লাইল, পৃষ্ঠা ৩০৬, হাদীস ৩০৯, মুসনাদ আহমাদ ৫/২৪০, ২৪৪) মুসনাদ আহমাদ, সুনান আবূ দাউদ এবং জামি‘উত তিরমিযীর মধ্যেও হাদীসটি রয়েছে। অন্য একটি বর্ণনায় এটাও আছে যে, মু‘আয (রাঃ) লোকটাকে তা পড়তে বলেন, কিন্তু সে তা পড়তে অস্বীকার করলো এবং ক্রোধ পর্যায়ক্রমে বাড়তেই থাকলো। (সুনান আবূ দাউদ ৪/৪৭৮০, জামি‘উত তিরমিযী ৫/৩৪৫২, আল ইয়াওমু ওয়াল লাইল, পৃষ্ঠা ৩০৬, হাঃ ৩০৯, মুসনাদ আহমাদ ৫/২৪০, ২৪৪। হাদীস য‘ঈফ। য‘ঈফ আবূ দাউদ হাঃ ৪১৪৯) ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, এই বৃদ্ধিযুক্ত অংশটি মুরসাল। অর্থাৎ ‘আব্দুর রহমান ইবনু আবূ লাইলা মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-এর সাক্ষাত পায়নি। কারণ তিনি হিজরী ২০ সালের পূর্বেই মৃত্যু বরণ করেছেন। তবে সম্ভাবনা রয়েছে যে, হয়তো ‘আব্দুর রহমান তা উবাই ইবনু কা‘বের কাছে শুনেছেন। তিনিও এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী এবং তিনি তা মু‘আয পর্যন্ত পৌছে দিয়েছেন। কেননা, এঘটনার সময় বহু সাহাবী জীবিত ছিলেন। সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, সুলাইমান ইবনু সূরাহ বলেছেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে আমরা উপবিষ্ট থাকা অবস্থায় দুই লোক তর্ক করছিলো। তাদের একজন অপরজনকে গালাগালি করছিলো এবং রাগে তার মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ হয়েছিলো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেনঃ আমি এমন একটি বাক্য জানি, যদি সে তা এখন উচ্চারণ করে তাহলে তার রাগান্বিত অবস্থা চলে যাবে। তা হলো আ‘উযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজীম বলা। তখন ঐ লোককে অন্যরা বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বলেছেন তা কি তুমি শুনতে পাওনি? লোকটি বললোঃ আমি পাগল নই। (সহীহুল বুখারী ৩১০৮, ৫৭০১, ৫৭৬৪, সহীহ মুসলিম ৪/১০৯, ১১০, ২০১৫, ৬৪১৩, সুনান আবূ দাঊদ ৪/৪৭৮১, সুনান নাসাঈ ১০২৩৩, আল ইয়াওমু ওয়াল লাইল, পৃষ্ঠা ৩০৭। তাফসীর তাবারী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ৯৭, হাঃ ১৩৯) সহীহ মুসলিম, সুনান আবূ দাঊদ এবং সুনান নাসাঈতেও বিভিন্ন সনদে এবং বিভিন্ন শব্দে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে আরো হাদীস রয়েছে। এ সবের বর্ণনার জন্য যিকর, ওযীফা এবং ‘আমলের বহু কিতাব রয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন। একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, জিবরাইল (আঃ) সর্বপ্রথম যখন প্রত্যাদেশ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আগমন করেন তখন প্রথমে أَعُوْذُ بِاللهِ পড়ার নির্দেশ দেন। তাফসীরে ইবনু জারীরে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রথম দফায় জিবরাইল (আঃ) মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট ওয়াহী এনে বলেন, أَعُوْذُ بِاللهِ পড়–ন। তিনি أَسْتَعِيْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ العَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পাঠ করেন। জিবরাইল (আঃ) পুনরায় বলেন, بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ পাঠ করুন। তারপর বলেন, اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَ অর্থাৎ পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। (তাফসীর তাবারী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা নং ৯৭, হাঃ ১৩৯। হাদীস যঈফ, যেমনটি লেখক বলেছেন) ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এটাই সর্বপ্রথম সূরাহ যা মহান আল্লাহ জিবরাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করেন। কিন্তু হাদীসটি গারীব এবং এর সনদের মধ্যে দুর্বলতা আছে। শুধু জেনে রাখার জন্যই এটা বর্ণনা করলাম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন। আ‘উযুবিল্লাহ পড়ার হুকুম জামহূর ‘উলামার হতে ‘ইসতি‘আযা’ বা আ‘উযুবিল্লাহ’ পড়া মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। সুতরাং তা না পড়লে পাপ হবে না। ‘আতা ইবনু আবী রিবাহ (রহঃ)-এর অভিমত এই যে, কুর’আন পাঠের সময় আ‘ঊযুবিল্লাহ পড়া ওয়াজিব, তা সালাতের মধ্যেই হোক বা সালাতের বাইরেই হোক। ইমাম রাযী (রহঃ) এই কথাটি নকল করেছেন। ‘আতার (রহঃ) কথার দালীল-প্রমাণ হলো আয়াতের প্রকাশ্য শব্দগুলো। কেননা এতে فَاسْتَعِذْ শব্দটি ‘আমর’ বা নির্দেশ সূচক ক্রিয়াপদ। ঠিক তদ্রুপ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সদা সর্বদা এর ওপর ‘আমলও তা অবশ্য করণীয় হওয়ার দালীল। এর দ্বারা শায়তানের দুষ্টমি ও দুস্কৃতি দূর হয় এবং তা দূর করাও এক রূপ ওয়াজিব। আর যা দ্বারা ওয়াজিব পূর্ণ হয় সেটাও ওয়াজিব হয়ে দাঁড়ায়। আশ্রয় প্রার্থনা অধিক সতর্কতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে এবং অবশ্যকরণীয় কাজের এটাও একটা মাধ্যম। কতিপয় বিদ্ব্যান এটাও বলেন যে, আউযুবিল্লাহ পাঠ কেবল রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপরই ওয়াজিব ছিলো, তাঁর উম্মাতের ওপর ওয়াজিব নয়। ইমাম মালিক (রহঃ) হতে এটাও বণনা আছে যে, ফরয সালাতের নয় বরং রামাযান মাসের প্রথম রাতের সালাতে ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়া উচিত। মাস’আলাহঃ ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) স্বীয় কিতাব ‘ইমলা’র মধ্যে লেখেছেন যে, أَعُوْذُ بِاللهِ উঁচ্চস্বরে পড়তে হবে। তবে আস্তেও পড়া যেতে পারে। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) স্বীয় ‘কিতাবুল উম্ম’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে এটাও লেখেছেন যে, সশব্দে ও নিরবে উভয়ভাবেই পড়ার অধিকার আছে। কারণ ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে ধীরে পড়ার এবং আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে উঁচ্চস্বরে পড়ার উক্তি সাব্যস্ত আছে। প্রথম রাকা‘আতে আউযুবিল্লাহ পড়ার ব্যাপারে ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)-এর দু’টি অভিমত রয়েছে। প্রথমটি মুস্তাহাব হওয়ার এবং দ্বিতীয়টি মুস্তাহাব না হওয়ার। প্রধান্য দ্বিতীয় মতের ওপরই রয়েছে। মহান আল্লাহই সঠিক ও সুষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) ও ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর নিকট শুধু أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়াই যথেষ্ট। কিন্তু কেউ কেউ বলেন যে, أَعُوْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ العَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْم পড়তে হবে। আবার কেউ কেউ বলেনঃ إِنَّ اللَّهَ هُوَ السَمِيْعُ العَلِيْمُ أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْم পড়তে হবে। সাওরী ও আওযা‘ঈ (রহঃ)-এর মাযহাব এটাই। কেউ কেউ বলেন যে, أَسْتَعِيْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়তে হবে। তাহলে আয়াতের সবগুলো শব্দের ওপর ‘আমলের পাশা পাশি ‘আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসের হাদীসের ওপরও ‘আমল হয়ে যাবে। একথা পূর্বেও বলা হয়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে যেসব বিশুদ্ধ হাদীস ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে ঐ গুলোই অনুসরণের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম। আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন। ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম ‏মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর মতে সালাতের মধ্যে ‘আ‘উযু বিল্লাহ’ পড়া হয় তিলাওয়াতের জন্য। ইমাম আবূ ইউসুফ (রহঃ)-এর মতে সালাতের জন্য পাঠ করা হয়। সুতরাং মুক্তাদিরও পড়ে নেয়া উচিত যদিও সে ক্বিরা’আত পড়ে না। ‘ঈদের সালাতেও প্রথম তাকবীরের পর পড়ে নেয়া কর্তব্য। জামহূর ‘উলামার মতে ‘ঈদের সালাতে সমস্ত তাকবীর বলার পর ‘আ‘উযু বিল্লাহ’ পড়তে হবে। তারপর ক্বিরা’আত পড়তে হবে। আ‘ঊযুবিল্লাহ বলার গুরুত্ব ও ফাযীলত আ‘ঊযুবিল্লাহির মধ্যে রয়েছে বিষ্ময়কর উপকার ও মাহাত্ম্য। অহেতুক কথা বলার ফলে মুখে যে অপবিত্রতা আসে তা বিদূরিত হয়। ঠিক তদ্রুপ এর দ্বারা মহান আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা হয় এবং তাঁর ব্যাপক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার কথা স্বীকার করা হয়। আর আধ্যাত্মিক ও প্রকাশ্য শত্রুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বীয় দুর্বলতা ও অপারগতার কথা স্বীকার করে নেয়া হয়। কেননা মানুষ শত্রুর মুকাবিলা করা যায়। অনুগ্রহ ও সদ্ব্যবহার দ্বারা তার শত্রুতা দূরা করা যায়। যেমন পবিত্র কুর’আনে ঐ আয়াতগুলোতে রয়েছে যেগুলো ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। অন্য জায়গায়া আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন যে, ﴿اِنَّ عِبَادِیْ لَیْسَ لَكَ عَلَیْهِمْ سُلْطٰنٌ وَ كَفٰى بِرَبِّكَ وَكِیْلًا﴾ নিশ্চয়ই আমার গোলামদের ওপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই; কর্ম বিধায়ক হিসাবে তোমার রাব্বই যথেষ্ট। (১৭ নং সূরাহ্ ইসরাহ, আয়াত নং ৬৫) যে মুসলিম কাফিরের হাতে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি শহীদ হোন। যে সেই গোপনীয় শত্রু শায়তানের হাতে মারা পড়ে সে মহান আল্লাহর দরবার থেকে বহিস্কৃত, বিতাড়িত হবে। মুসলিমের ওপর কাফিররা জয়যুক্ত হলে মুসলিম প্রতিদান পেয়ে থাকেন। কিন্তু যার ওপর শায়তান জয়যুক্ত হয় সে ধ্বংস হয়ে যায়। শায়তান মানুষকে দেখতে পায়, কিন্তু মানুষ শায়তানকে দেখতে পায় না বলে কুর’আনুল কারীমের শিক্ষা হলোঃ ‘তোমরা তার অনিষ্ট হতে তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো যিনি শায়তানকে দেখতে পান, কিন্ত সে তাঁকে দেখতে পায় না। আ‘ঊযুবিল্লাহ পাঠের নিগূঢ় তত্ত্ব আ‘ঊযুবিল্লাহ পড়া হলো মহান আল্লাহর নিকট বিনীত হয়ে প্রার্থনা করা এবং প্রত্যেক অনিষ্টকারীর অনিষ্টতা হতে তাঁর নিকট আশ্রয় চাওয়া। عَيَاذُه-এর অর্থ হলো অনিষ্টতা দূর করা, আর أَيَاذُه -এর অর্থ হলো মঙ্গল ও কল্যাণ লাভ করা। এর প্রমাণ হিসেবে মুতানাব্বির এই কবিতাটি প্রণিধানযোগ্যঃ يَا مَنْ أَلُوْذُ بِهِ فِيْمَا أَؤُمِّلُهُ ... وَمَنْ أَعُوْذُ بِهِ مِمَّنْ أُحَاذِرُهُ لَا يُجْبَرُ النَّاسُ عَظْمًا أَنْتَ كَاسِرُهُ ... وَلَا يَهِيْضُوْنَ عَظْمًا أَنْتَ جَابِرَهُ হে সেই পবিত সত্তা! যে সত্তার সাথে সাথে আমার সমুদয় আশা ভরসা বিজড়িত হয়েছে। আর হে সেই পালনকর্তা! যার নিকট আমি সমস্ত অমঙ্গল থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। যা তিনি ভেঙ্গে দেন তা কেউ জোড়া দিতে পারে না। আর যা তিনি জোড়া দেন তা কেউ ভাঙ্গতে পারে না। ‘আ‘ঊযু’ এর অর্থ হলো এই যে, আমি মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাচ্ছি যেন বিতাড়িত শায়তান ইহজগতে ও পরজগতে আমার কোন ক্ষতি করতে না পারে। যে নির্দেশাবলী পালনের জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি তা পালনে যেন আমি বিরত না হয়ে পড়ি। আবার যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে তা যেন আমি না করি। এটা তো বলাই বাহুল্য যে, শায়তানের অনিষ্টতা হতে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ব্যতীত আর কেউ রক্ষা করতে পারে না। এ জন্য বিশ্ব প্রভু মহান আল্লাহ মানুষরূপী শায়তানের দুষ্কার্য ও অন্যায় থেকে নিরাপত্তা লাভ করার যে পন্থা শিখালেন তা হলো তাদের সাথে সদাচরণ। কিন্তু জ্বিন রূপী শায়তানের দুষ্টুমী ও দু®কৃতি থেকে রক্ষা পাওয়ার যে উপায় তিনি বলে দিলেন তা হলো তাঁর স্মরণে আশ্রয় প্রার্থনা। কেননা না তাকে ঘুষ দেয়া যায়, না তার সাথে সদ্ব্যবহারের ফলে সে দুষ্টুমী হতে বিরত হয়। তার অনিষ্টতা হতে তো বাঁচাতে পারেন একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন। প্রাথমিক তিনটি আয়াতে এ বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। সূরাহ্ আল আ‘রাফে আছেঃ ﴿خُذِ الْعَفْوَ وَ اْمُرْ بِالْعُرْفِ وَ اَعْرِضْ عَنِ الْجٰهِلِیْنَ ﴾ ‘তুমি বিনয় ও ক্ষমা পরায়ণতার নীতি গ্রহণ করো এবং লোকদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দাও, আর মূর্খদেরকে এড়িয়ে চলো।’ (৭ নং সূরাহ্ আ‘রাফ, আয়াত নং ১৯৯) এটা হলো মানুষের সাথে ব্যবহার সংক্রান্ত। তারপর একই সূরায় মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ ﴿وَ اِمَّا یَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّیْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ اِنَّه سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ﴾ শায়তানের কু-মন্ত্রনা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে তুমি মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।(৭ নং সূরাহ্ আ‘রাফ, আয়াত নং ২০০) সূরাহ্ মু’মিনে রয়েছেঃ ﴿اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ السَّیِّئَةَ. نَحْنُ اَعْلَمُ بِمَا یَصِفُوْنَ. وَ قُلْ رَّبِّ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزٰتِ الشَّیٰطِیْنِۙ. وَ اَعُوْذُ بِكَ رَبِّ اَنْ یَّحْضُرُوْنِ﴾ মন্দের মুকাবিলা করো উত্তম দ্বারা, তারা যদি বলে আমি সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। আর বলোঃ হে আমার প্রভু! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি শায়তানের প্ররোচনা হতে। হে আমার রাব্ব! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট ওদের উপস্থিতি হতে। (২৩ নং সূরাহ্ মু’মিনূন, আয়াত নং ৯৬-৯৮) অতঃপর মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ ﴿وَ لَا تَسْتَوِی الْحَسَنَةُ وَ لَا السَّیِّئَةُ. اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ فَاِذَا الَّذِیْ بَیْنَكَ وَ بَیْنَه عَدَاوَةٌ كَاَنَّه وَلِیٌّ حَمِیْمٌ. وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا الَّذِیْنَ صَبَرُوْا١ۚ وَ مَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا ذُوْ حَظٍّ عَظِیْمٍ. وَ اِمَّا یَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّیْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ. اِنَّه هُوَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ﴾ ভালো এবং মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত করো উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল, এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকেই যারা মহাভাগ্যবান। যদি শায়তানের কু-মুন্ত্রনা তোমাকে প্ররোচিত করে তাহলে মহান আল্লাহকে স্মরণ করবে তিনি সর্বশ্রোত, সর্বজ্ঞ। (৪১ নং সূরাহ্ হা-মীম সাজদাহ, আয়াত নং ৩৪-৩৬) শায়তান শব্দটির আভিধানিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ‘আরবী ভাষার অভিধানে شَيْطَان শব্দটি شَطَنٌ থেকে বর্ণিত। এর আভিধানিক অর্থ হলো দূরত্ব। যেহেতু এই মারদুদ ও অভিশপ্ত শায়তান প্রকৃতগতভাবে মানব প্রকৃতি থেকে দূরে রয়েছে , বরং নিজের দু®কৃতির কারণে প্রত্যেক মঙ্গল ও কল্যাণ থেকে দূরে আছে, তাই তাকে শায়তান বলা হয়। এ কথাও বলা হয়েছে যে, এটা شَاطَ থেকে গঠিত হয়েছে। কেননা সে আগুন থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং شَاطَ এর অর্থ এটাই। কেউ কেউ বলেন যে, অর্থের দিক দিয়ে দু’টোই ঠিক। কিন্তু প্রথমটিই বিশুদ্ধতর। ‘আরব কবিদের কবিতার মধ্যে এর সত্যতা প্রমাণিত হয় সর্বতোভাবে। সুলাইমান (আঃ)-কে যে শক্তি দেয়া হয়েছিলো তার উল্লেখ করে কবি উমাইয়া ইবনু আবী সালত বলেনঃ أيما شاطِنٍ عصاه عكاه ... ثمّ يُلْقى في السِّجْن والأغلال কবি নাবেগা বলেনঃ نأت بسعاد عنك نَوًى شَطُونُ ... فبانت والفؤادُ بها رَهِينُ সীবাওয়াইর উক্তি আছে যে, যখন কেউ শায়তানী কাজ করে তখন ‘আরবরা বলেঃ تشيطن فلان কিন্তু যদি شاط থেকে নির্গত হতো তাহলে বলতো تَشَيَّطَ। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ শব্দটি شَاطَ থেকে নয়, বরং شطَنٌ হতেই নেয়া হয়েছে। এর সঠিক অর্থ হচ্ছে দূরত্ব। কোন জ্বিন, মানুষ বা চতুষ্পদ প্রাণী দুষ্টুমী করলে তাকে শায়তান বলা হয়। কুর’আনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছেঃ ﴿وَ كَذٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیْنَ الْاِنْسِ وَ الْجِنِّ یُوْحِیْ بَعْضُهُمْ اِلٰى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًا وَ لَوْ شَآءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوْهُ فَذَرْهُمْ وَ مَا یَفْتَرُوْنَ﴾ ‘আর এমনিভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্য বহু শায়তানকে শত্রুরূপে সৃষ্টি করেছি; তাদের কতক মানুষ শায়তানের মধ্য থেকে এবং কতক জ্বিন শায়তানের মধ্য থেকে হয়ে থাকে, এরা একে অন্যকে কতকগুলো মনোমুগ্ধকর ধোঁকাপূর্ণ ও প্রতারণামূলক কথা দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে।’ (৬ নং সূরাহ্ আন’আন, আয়াত নং ১১২) মুসনাদ আহমাদে আবূ যার (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তিনি বলেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বলেছেনঃ يَا أَبَا ذَرٍّ، تَعَوّذْ بِاللهِ مِنْ شَيَاطِيْنِ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ "، فَقُلْتُ: أَوَ لِلْإِنْسِ شَيَاطِيْنُ؟ قَالَ: " نَعَمْ " ‘হে আবূ যার! দানব ও মানব শায়তান হতে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো।’ আমি বলি, মানুষের মধ্যেও কি শায়তান আছে? তিনি বলেনঃ হ্যাঁ’ (মুসনাদ আহমাদ ৫/১৭৮, সুনান নাসাঈ ৮/৫৫২২, হাদীস যঈফ) সহীহ মুসলিমে আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ يَقْطَعُ الصَّلَاةَ الْمَرْأَةُ وَالْحِمَارُ وَالْكَلْبُ الْأَسْوَدُ ‘মহিলা, গাধা এবং কালো কুকুর সালাত নষ্ট করে দেয়।’ তিনি বলেন, হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! লাল, হলদে কুকুর হতে কালো কুকুরকে স্বতন্ত্র করার কারণ কি?’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ ‘কালো কুকুর শায়তান।’ (সহীহ মুসলিম ১/ ২৬৫/৩৬৫, সুনান আবূ দাউদ ১/৯৫২, মুসনাদ আহমাদ ৫/ ১৪৯, ১৫১, ১৬০, ১৬১, হাদীস সহীহ) যায়দ ইবনু আসলাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেনঃ ‘উমার (রাঃ) একবার তুর্কী ঘোড়ার ওপরে আরোহণ করেন। ঘোড়াটি সগর্বে চলতে থাকে। ‘উমার (রাঃ) ঘোড়াটিকে মারপিটও করতে থাকেন। কিন্তু এর সদর্প চাল-চলন আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি নেমে পড়েন এবং বলেনঃ ‘আমার আরোহণের জন্য তুমি কোন শায়তানকে ধরে এনেছো! আমার মনে অহঙ্কারের ভাব এসে গেছে। সুতরাং আমি এর পৃষ্ঠ থেকে নেমে পড়াই ভালো মনে করলাম। (তাফসীর তাবারী ১/১১১) ‘রাজীম’ শব্দের অর্থ رَجِيْمِ শব্দটি فَعِيْل-এর ওযনে اسم مَفْعُوْل-এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সে মারদূদ বা বিতাড়িত। অর্থাৎ প্রত্যেক মঙ্গল থেকে সে দূরে আছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ﴿وَ لَقَدْ زَیَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنْیَا بِمَصَابِیْحَ وَ جَعَلْنٰهَا رُجُوْمًا لِّلشَّیٰطِیْنِ﴾ আমি নিকটবর্তী আকাশকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং এগুলোকে করেছি শায়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ। (৬৭ নং সূরাহ্ মুলক, আয়াত নং ৫) অপর আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ ﴿اِنَّا زَیَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنْیَا بِزِیْنَةِ اِ۟لْكَوَاكِبِۙ۝۶ وَ حِفْظًا مِّنْ كُلِّ شَیْطٰنٍ مَّارِدٍۚ۝۷ لَا یَسَّمَّعُوْنَ اِلَى الْمَلَاِ الْاَعْلٰى وَ یُقْذَفُوْنَ مِنْ كُلِّ جَانِبٍۗۖ۝۸ دُحُوْرًا وَّ لَهُمْ عَذَابٌ وَّاصِبٌۙ۝۹ اِلَّا مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَاَتْبَعَهٗ شِهَابٌ ثَاقِبٌ﴾ আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্র রাজির সুষমা দ্বারা সুশোভিত করেছি। আর রক্ষা করেছি প্রত্যেক বিদ্রোহী শায়তান থেকে। ফলে তারা উর্ধ্ব জগতের কিছু শ্রবণ করতে পারে এবং তাদের প্রতি উল্কা নিক্ষিপ্ত হয় সকল দিক থেকে বিতাড়নের জন্য এবং তাদের জন্য রয়েছে অবিরাম শক্তি। তবে কেউ হঠাৎ কিছু শুনে ফেললে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড তার পশ্চাদ্ধাবন করে। (৩৭ নং সূরাহ্ সাফফাত, আয়াত নং ৬-১০) অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ ﴿وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِی السَّمَآءِ بُرُوْجًا وَّ زَیَّنّٰهَا لِلنّٰظِرِیْنَۙ۝۱۶ وَ حَفِظْنٰهَا مِنْ كُلِّ شَیْطٰنٍ رَّجِیْمٍۙ۝۱۷ اِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ فَاَتْبَعَهٗ شِهَابٌ مُّبِیْنٌ﴾ আকাশে আমি গ্রহ নক্ষত্র সৃষ্টি করেছি এবং একে দর্শকদের জন্য সুশোভিত করেছি। প্রত্যেক অভিশপ্ত শায়তান থেকে আমি একে রক্ষা করে থাকি। আর কেউ চুরি করে সংবাদ শুনতে চাইলে এর পশ্চাদ্ধাবন করে প্রদীপ্ত শিখা। (১৫ নং সূরাহ্ হিজর, আয়াত নং ১৬-১৮) رَجِيْمٌ এর একটি অর্থ رَجْمٌ-ও করা হয়েছে। যেহেতু শায়তান মানুষকে কু-মন্ত্রণা এবং ভ্রান্তির দ্বারা রজম করে থাকে এজন্যে তাকে ‘রাজীম’ অর্থাৎ ‘রাজিম’ বলা হয়। ‘বিসমিল্লাহ’ কি সূরাহ্ ফাতিহার প্রথম আয়াত? بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ. অতীব মেহেরবান পরম করুণাময় মহান আল্লাহর নামে আরম্ভ করেছি। সকল সাহাবী (রাঃ) মহান আল্লাহর কিতাব কুর’আন মাজীদকে বিসমিল্লাহ দ্বারাই আরম্ভ করেছেন। ‘আলিমগণ এ বিষয়ে একমত যে, সূরাহ্ ‘নামল’ এর এটি একটি আয়াত। তবে এটি প্রত্যেক সূরার একটি আয়াতের অংশ বিশেষ কি-না, কিংবা এটি কি শুধুমাত্র সূরাহ্ ফাতিহারই আয়াত, অন্য সূরার নয়, কিংবা এক সূরাহ্কে অন্য সূরাহ্ হতে পৃথক করার জন্যই কি একে লেখা হয়েছে এবং এটি আদৌ আয়ত নয়, এ সব বিষয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ‘আলিমগণের মধ্যে অনেক মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়, অন্য স্থানে এর বিস্তারিত বিবরণও আছে। সুনানে আবি দাউদে সহীহ সূত্রে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে একটি সূরাহকে অন্য সূরাহ হতে পৃথক করার বিষয়টি বুঝতেন না। মুসতাদরাক হাকিম এর মধ্যে এ হাদীসটি বর্ণিত আছে। সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর (রহঃ) থেকেও হাদীসটি মুরসাল রূপে বর্ণিত হয়েছে। আর সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্তে উম্মু সালামাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘বিসমিল্লাহ’ কে সূরাহ ফাতিহার পূর্বে সালাতে পড়েছেন এবং তাকে একটি পৃথক আয়াতরূপে গণ্য করেছেন। কিন্তু এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী ‘উমার ইবনু হারূন বালখী উসূলে হাদীসের পরিভাষায় দুর্বল। এর অনুসরণে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতেও একটা হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর অনুরূপভাবে ‘আলী, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ থেকেও বর্ণিত আছে। ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ), ইবনু ‘উমার, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) ‘আলী (রাঃ), তাবি‘ঈদের মধ্য থেকে ‘আতা (রহঃ), তাউস (রহঃ), সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর (রহঃ), মাকহুল (রহঃ) এবং যুহরী (রহঃ)-এর এটাই নীতি বা অভিমত যে, ‘বিসমিল্লাহ’ সূরাহ্ বারাআত’ ছাড়া আল কুর’আনের প্রত্যেক সূরারই একটা পৃথক আয়াত। তাছাড়া ‘আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক, ইমাম শাফি‘ঈ, আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর অন্য এক বর্ণনায়ও এমন মত পোষণ করেছেন। ইমাম আহমাদ (রহঃ)-এর একটি কাওল এবং ইসহাক ইবনু রাহ্ওয়াইহ্ (রহঃ) ও আবূ ‘উবাইদ কাসিম ইবনু সালাম (রহঃ)-এরও এটাই অভিমত। তবে ইমাম মালিক (রহঃ) এবং ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এবং তাঁদের সহচরগণ বলেন যে, ‘বিসমিল্লাহ’ সূরাহ্ ফাতিহারও আয়াত নয় বা অন্য কোন সূরারও আয়াত নয়। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)-এর একটি উক্তি এমন যে, এটা সূরাহ ফাতিহার একটি আয়াত, তবে অন্য কোন সূরাহ এর আয়াত নয়। তাঁর অন্য একটি উক্তি এই যে, এটা প্রত্যেক সূরাহ এর প্রথম আয়াতের অংশ বিশেষ। কিন্তু হাদীসের পরিভাষায় এ দুই উক্তিই হচ্ছে গারীব। দাউদ (রহঃ) বলেনঃ এটা প্রত্যেক সূরাহ এর প্রথমে একটি পৃথক আয়াত, যা সূরাহ এর অন্তর্ভুক্ত নয়। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। আর আবূ বাকর রাযী, আবূ হাসান কুরখী (রহঃ)-এরও মাযহাব এটাই। আবূ হাসান কুরখী (রহঃ) ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর একজন বড় মর্যাদাসম্পন্ন সহচর। এ হলো ‘বিসমিল্লাহ’ সূরাহ ফাতিহার আয়াত হওয়া না হওয়ার আলোচনা। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উচ্চস্বরে পাঠ করা প্রসঙ্গ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উচ্চস্বরে পাঠ করতে হবে নাকি নিম্নস্বরে এ নিয়েও মতভেদ রয়েছে। যারা একে সূরাহ্ ফাতিহার পৃথক একটি আয়াত মনে করেন না তারা একে নিম্ন স্বরে পড়ার পক্ষপাতি। এখন অবশিষ্ট রইলেন শুধু ঐ সব লোক যারা বলেন যেমন এটি প্রত্যেক সূরার প্রথম আয়াত। তাদের মধ্যেও আবার মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ)-এর অভিমত এই যে, সূরাহ্ ফাতিহা ও অন্যান্য প্রত্যেক সূরার পূর্বে একে উচ্চস্বরে পড়তে হবে। সাহাবা (রাঃ), তাবি‘ঈন (রহঃ) এবং মুসলিমদের পূর্ববর্তী যুগের ইমামগণের এটাই মাযহাব। সাহাবীগণের (রাঃ) মধ্যে একে উচ্চস্বরে পড়ার পক্ষপাতি হলেন আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) ইবনু ‘উমার (রাঃ), ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ), মু‘আবিয়াহ (রাঃ), ‘উমার (রাঃ), আবূ বাকর (রাঃ) এবং ‘উসমান (রাঃ)। আবূ বাকর (রাঃ) এবং ‘উসমান (রাঃ) থেকেও গারীব বা দুর্বল সনদে ইমাম খতীব (রহঃ) এটা নকল করেছেন। বায়হাকী (রহঃ) ও ইবনু ‘আবদুল র্বা (রহঃ) ‘উমার (রাঃ) ও ‘আলী (রাঃ) থেকেও এটি বর্ণনা করেছেন। তাবি‘ঈগণের মধ্যে সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর (রহঃ), ইকরামাহ (রহঃ), আবূ কালাবাহ্ (রহঃ), যুহরী (রহঃ), ‘আলী ইবনু হাসান (রহঃ), তাঁর ছেলে মুহাম্মাদ (রহঃ), সা‘ঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব (রহঃ), ‘আতা (রহঃ), তাউস (রহঃ), মুজাহিদ (রহঃ), সালিম (রহঃ), মুহাম্মাদ ইবনু কা‘ব কারাযী (রহঃ), আবূ বাকর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু ‘আমর (রহঃ) ইবনু হাযাম, আবূ ওয়ায়িল (রহঃ), ইবনু সীরিন (রহঃ), তাঁর ছেলে মুনকাদির (রহঃ), ‘আলী ইবনু ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রহঃ) তাঁর ছেলে, মুহাম্মাদ, ইবনু ‘উমার (রাঃ)-এর গোলাম নাফি‘, যায়দ ইবনু আসলাম (রহঃ), ‘উমার ইবনু ‘আবদুল ‘আযীয (রহঃ), আযরাক ইবনু কায়িস (রহঃ), হাবীব ইবনু আবী সাবিত (রহঃ), আবূ শা’সা (রহঃ), মাকহুল (রহঃ), ‘আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল ইবনু মাকরান (রহঃ), এবং বায়হাকীর বর্ণনায় ‘আবদুল্লাহ ইবনু সাফওয়ান (রহঃ), মুহাম্মাদ ইবনু হানফিয়্যাহ (রহঃ) এবং ‘আবদুল বারের বর্ণনায় ‘আমর ইবনু দীনার (রহঃ)। তাঁরা সবাই সালাতের যেখানে কিরা’আত উচ্চস্বরে পড়া হয়, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমকেও উচ্চ শব্দে পড়তেন। এর একটি প্রধান দালীল এই যে, এটি যখন সূরাহ্ ফাতিহারই একটি আয়াত তখন পূর্ণ সূরার ন্যায় একে উচ্চস্বরে পড়তে হবে। তাছাড়া সুনান নাসাঈ, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্, সহীহ ইবনু হিব্বান, মুসতাদরাক হাকিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) সালাত আদায় করলেন এবং কিরা’আত পড়লেন এবং কিরা’আতে উচ্চ শব্দে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পড়লেন এবং সালাত শেষে বললেনঃ ‘তোমাদের সবার চেয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সালাতের সাথে আমার সালাতেরই সামঞ্জস্য বেশি।’ (সুনান নাসাঈ ২/৯০৪, ইবনু খুযায়মাহ ১/৪৯৯, ইবনু হিব্বান ৩/১৪৫ পৃষ্ঠা, মুসতাদরাক হাকিম ১/২৩২, দারাকুতনী ১/৩০৫ এবং সুনান বায়হাকী ২/৪৬। হাদীস সহীহ) সুনান আবূ দাউদ ও জামি‘উত তিরমিযীর মধ্যে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘বিসমিল্লাহির রহমানরি রাহীম’ দ্বারা সালাত শুরু করতেন। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন হাদীসটি সঠিক নয়। (জামি‘উত তিরমিযী ২/ ২৪৫, শারহুস সুন্নাহ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৭, হাদীস ৫৮৫, তুহফাতুল আশরাফ ৫/২৬৫, নাসবুর রায় ১/৩৪৬, তালখীসুল হুবাইর ১/২৩৪। হাদীস যঈফ) মুসতাদরাকে হাকিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘বিসমিল্লাহির রহমানরি রাহীম’ উঁচ্চস্বরে পড়তেন। ইমাম হাকিম (রহঃ) এ হাদীসকে সঠিক বলেছেন। (মুসতাদরাক হাকিম ১/২০৮, নাসবুর রায় ১/৪৬৭, ইমাম হাকিম (রহঃ) হাদীসটিকে সহীহ বললেও ইমাম যায়লা‘ঈ যঈফ বলেছেন) সহীহুল বুখারীতে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তাকে তথা আনাস (রাঃ)-কে ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কিরা’আত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যে তা কিরূপ ছিলো? উত্তরে তিনি বললেনঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেক মাদের শব্দকে লম্বা করে পড়তেন।’ তিনি بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ পাঠ করে শুনালেন এবং বললেন بِسْمِ اللّٰهِ-এর ওপর মদ্ বা লম্বা করেছেন। الرَّحْمٰنِ-এর ওপর মদ্ করেছেন ও الرَّحِیْمِ-এর ওপর মদ্ করেছেন অর্থাৎ লম্বা করে টেনে পড়েছেন। (ফাতহুল বারী ৮/৭০৯। সহীহুল বুখারী ১/৫০৪৬) মুসনাদ আহমাদ, সুনান আবূ দাঊদ, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ এবং মুসতাদরাক হাকিমে উম্মু সালামাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেক আয়াত শেষে থামতেন এবং তাঁর কিরা’আত পৃথক হতো। যেমন بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ পড়ে থামতেন, তারপর اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ পড়তেন, পুনরায় থেমে الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ পড়তেন। দারাকুতনী (রহঃ) এ হাদীসটিকে সঠিক বলেছেন। (মুসনাদ আহমাদ ৬/৩০২, সুনান আবূ দাঊদ ৪/৪০০১, জামি‘উত তিরমিযী ৫/২৯২৩, সহীহ ইবনু খুযায়মাহ্ ১/২৪৮, হাকিম ২/২৩১, দারাকুতনী ১/৩১৩, হাদীস সহীহ) ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) ও ইমাম হাকিম (রহঃ) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মু‘আবিয়াহ (রাঃ) মাদীনায় সালাত পড়ালেন এবং ‘বিসমিল্লাহ’ পড়লেন না। সে সময় যেসব মুহাজির সাহাবী (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন তাঁরা এতে আপত্তি জানালেন। সুতরাং তিনি পুনরায় যখন সালাত আদায় করানোর জন্য দাঁড়ালেন তখন উচ্চস্বরে ‘বিসমিল্লাহ’ পাঠ করলেন। (মুসতাদরাক হাকিম ১/২৩৩, মুসনাদ আশ শাফি‘ঈ ১/৮০। ইমাম হাকিম (রহঃ) বলেন, ইমাম মুসলিম -এর শর্তানুসারে হাদীসটি সহীহ। অত্র হাদীসের একজন রাবী আব্দুল মাজীদ ইবনু আব্দুল আযীয কে হাফিয ইবনু হাজার আল ‘আসকালানী ‘মাতরূক’ তথা বর্জনীয় বলে আখ্যা দিয়েছেন) প্রায় নিশ্চিতরূপেই উল্লিখিত সংখ্যক হাদীস এ মাযহাবের দালীলের জন্য যথেষ্ট। এখন বাকী থাকলো তাঁদের বিপক্ষের হাদীস বর্ণনা ও সনদের দুর্বলতা ইত্যাদি। এগুলোর জন্য অন্য জায়গা রয়েছে। দ্বিতীয় অভিমত এই যে, ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে পড়তে হবে না। খালীফা চতুষ্টয়, ‘আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফ্ফাল, তাবি‘ঈন ও পরবর্তী যুগের দলসমূহ থেকে এটা সাব্যস্ত আছে। আবূ হানীফা (রহঃ), সাওরী (রহঃ) এবং আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ)-এর এটাই অভিমত। ইমাম মালিকের (রহঃ) অভিমত এই যে, ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তেই হবে না, জোরেও নয়, আস্তেও নয়। তাঁর প্রথম দালীল তো সহীহ মুসলিমের ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি যাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতকে তাকবীর ও কিরা’আত اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ দ্বারা শুরু করতেন। (সহীহ মুসলিম ১/ ২৪০, ৩৫৭, ৩৫৮, ইবনু মাজাহ ১/৮১২, মুসনাদ আহমাদ ৬/৩১, ১৯৪, সুনান আবূ দাউদ ৭৮৩, সুনান বায়হাকী ২০৯৩, ২২৪৪, ২৭৮৫, সুনান দারিমী ১২৩৬, হাদীস সহীহ) সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আছে যে, আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ ‘আমি মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবূ বাকর (রাঃ), ‘উমার (রাঃ), এবং ‘উসমান (রাঃ)-এর পিছনে সালাত আদায় করেছি। তাঁরা সবাই اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ দ্বারা সালাত আরম্ভ করতেন। সহীহ মুসলিমে আছে যে, বিসমিল্লাহ পাঠ করতেন না। কিরা’আতের প্রথমেও না, শেষেও না। (ফাতহুল বারী ২/২৬৫, সহীহুল বুখারী ২/৭৪৩, সহীহ মুসলিম ১/৫২/২৯৯) সুনানে ‘আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফ্ফাল (রাঃ) থেকেও এরূপই বর্ণিত আছে। (জামি‘উত তিরমিযী ২৪৪) এ হলো ঐসব ইমামের ‘বিসমিল্লাহ’ আস্তে পড়ার দালীল। এ প্রসঙ্গে এটাও জ্ঞাতব্য যে, এটি কোন বড় রকমের মতভেদ নয়। প্রত্যেক দলই এ বিষয়ে একমত যে, ‘বিসমিল্লাহ’ উঁচ্চস্বরে পড়ুক আর নীরবে পড়ুক সালাত শুদ্ধ হবে। ‘বিসমিল্লাহর’ গুরুত্ব ও ফাযীলত ইমাম, জ্ঞানী, পণ্ডিত, ‘আবিদ আবূ মুহাম্মাদ ‘আব্দুর রহমান ইবনু আবী হাতিম (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘উসমান ইবনু ‘আফ্ফান (রাঃ) ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বললেন, তা হলো মহান আল্লাহর নাম সমূহের একটি নাম। মহান আল্লাহর বড় নাম এবং বিসমিল্লাহর মধ্যে এতদুর নৈকট্য রয়েছে, যেমন নৈকট্য রয়েছে চক্ষুর কালো অংশ ও সাদা অংশের মাঝে। (হাদীস খুবই য‘ঈফ, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫৫২. সুনান বায়হাকী শু‘আবুল ইমান ২/৪৩৭) আবূ বাকর ইবনু মারদুওয়াই (রহঃ) ও স্বীয় তাফসীরে এরূপ বর্ণনা করেছেন। অবশ্য তিনি দু’টি সূত্র বর্ণনা করেছেন। তার দ্বিতীয় বর্ণনাটি হলো, আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘ঈসা (আঃ)-এর মা মারইয়াম (আঃ) যখন তাকে মক্তবে নিয়ে গিয়ে শিক্ষকের সামনে বসালেন, তখন তাকে বললেন, ‘বিসমিল্লাহ’ লেখুন। ‘ঈসা (আঃ) বললেন, ‘বিসমিল্লাহ’ কি? শিক্ষক উত্তরে বললেন, আমি জানি না। তিনি বললেন, بِ এর ভাবার্থ হলো بهاء الله অর্থাৎ আল্লাহর উঁচ্চতা, س এর ভাবার্থ হলো سناءه অর্থাৎ আল্লাহর আলোক,। م এর তাৎপর্য হলো مملكته বা আল্লাহর রাজত্ব। الله বলে উপাস্যদের উপাস্যদেরকে। رحمن বলে দুনিয়া ও আখিরাতের করুণাময়কে। আর আখিরাতে যিনি দয়া প্রদর্শন করবেন তাকে رحيم বলা হয়। (হাদীসটি মাওযু‘ ইবনুল জাওযী স্বীয় মাওযু‘আতের মধ্যে উল্লেখ করেছেন। অত্র হাদীসের সনদে ইসমা‘ঈল ইবনু ইয়াহ্ইয়াহ্ নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে) ইবনু জারীর (রহঃ) ও স্বীয় তাফসীরে এরূপ বর্ণনা করেছেন। (তাফসীর তাবারী, প্রথম খণ্ড, হাঃ ১৪৭, হাদীস যঈফ) কিন্তু সনদের দিক থেকে তা খুবই দুর্বল। হতে পারে যে, এটি কোন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে কিংবা এমনও হতে পারে যে, বানী ইসরাইলের বর্ণনা সমূহের একটি বর্ণনা। এটা মারফূ‘ হাদীস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অবশ্য মহান আল্লাহই এ ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। ইবনু মারদুওয়াই এর তাফসীরে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আমার ওপর এমন একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যা আমি ও সুলায়মান ইবনু দাউদ (আঃ) ব্যতীত অন্য কারো ওপর অবতীর্ণ হয়নি। আয়াতটি হলো, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’। (হাদীসটি য‘ঈফ) জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন, যখন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ অবতীর্ণ হলো, তখন পূর্বদিকে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। বায়ূ মণ্ডলী স্তব্ধ হয়ে যায়। তরঙ্গমালা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে প্রশান্ত হয়ে উঠে। জন্তুগুলো কান লাগিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে। আকাশ থেকে অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হয়ে শায়তানকে বিতাড়ন করে এবং বিশ্বপ্রভু স্বীয় সম্মান ও মর্যাদার কসম করে বলেন, যে জিনিসের ওপর আমার এ নাম নেয়া হবে তাতে অবশ্যই বরকত হবে। (হাদীসটি সহীহ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) বলেন, জাহান্নামের ঊনিশটি দরজার হাত হতে যে বাঁচতে চায়, সে যেন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ পড়ে। কেননা এতেও ঊনিশ অক্ষর বিদ্যমান। আর এর প্রতিটি অক্ষরের বিনিময়ে তার জন্য মহান আল্লাহ একজন রক্ষক নির্ধারণ করবেন। (তাফসীরে কুরতুবী, ১/১০৭, সহীহুল বুখারী ২/৭৯৯) কুরতুবীর সমর্থনে ইবনু ‘আতিয়্যাহ এটা বর্ণনা করেছেন এবং এর প্রষ্ঠপোষকতায় তিনি আরও একটি হাদীস এনেছেন। তাতে রয়েছেঃ فقد رأيت بضعة وثلاثين ملكا يبتدرونها অর্থাৎ আমি স্বচক্ষে ত্রিশের বেশি ফিরিশতা দেখেছি, যারা এটা নিয়ে তাড়াহুড়া করছিলেন। এটা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই সময় বলেছিলেন যখন একজন লোক رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ পাঠ করেছিলেন। এর মধ্যে ত্রিশের বেশি অক্ষর রয়েছে। তৎসংখ্যক ফিরিশতাও অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এ রকমই বিসমিল্লাহর মধ্যে ঊনিশটি অক্ষর আছে এবং তথায় ফিরিশতার সংখ্যাও হবে ঊনিশ। (হাদীস সহীহ, মুসনাদ আহমাদ ৫/৫৯, ৭১, মুসতাদরাক হাকিম ৪/২২৯) মুসনাদ আহমাদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাওয়ারীর ওপর তাঁর পিছনে যে সাহাবী (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন তাঁর বর্ণনাটি এইঃ ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উষ্ট্রীটির কিছু পদস্খলন ঘটলে আমি বললাম যে, শায়তানের সর্বনাশ হোক। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমরা তা থেকে অভিশপ্ত শায়তান বলো না, কারণ এতে সে গর্বে বড় হয়ে যায়, এমনকি একটি বড় ঘর হয়ে যায়। বরং বিসমিল্লাহ বলো, কারণ এতে শায়তান ছোট হতে হতে মাছির মতো হয়ে যায়। (আল ‘আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইল ৫৫৫, সহীহুল জামি‘ ৭৪০১, মুসনাদ আহমাদ ৫/৫৯) এটাই হলো একমাত্র বিসমিল্লাহর বরকতের প্রভাব।’ আর এ জন্যই প্রত্যেক কাজের শুরুতে এবং বক্তব্যের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা মুস্তাহাব। অতএব খুতবার শুরুতেও ‘বিসমিল্লাহ’ বলা মুস্তাহাব। যেমন হাদীসে এসেছে যে কাজ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ব্যতীত শুরু করা হয় তা লেজ কাটা, তথা বরকতশুন্য। (হাদীস য‘ঈফ) প্রতিটি কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার বিধান ওপরোল্লিখিত বরকতের ভিত্তিতেই প্রত্যেক কাজ ও কথার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। খুতবার শুরুতেও বিসমিল্লাহ বলা উচিত। হাদীসে আছে যে, বিসমিল্লাহ দ্বারা যে কাজ আরম্ভ করা না হয় তা কল্যাণহীন ও বরকতশূন্য থাকে। বিভিন্ন হাদীসের ভিত্তিতে টয়লেট বা বাথরুমে প্রবেশ কালেও বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। অনুরূপভাবে ওযূর শুরুতেও বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। কেননা মুসনাদ আহমাদ এবং সুনানের কিতাবে রয়েছে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ), সা‘ঈদ ইবনু যায়দ (রহঃ) এবং আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ لَا وُضُوءَ لِمَنْ لَمْ يَذْكُرِ اسْمَ اللهِ عَلَيْهِ অর্থাৎ যে ব্যক্তি ওযূর সময় বিসমিল্লাহ বলে না, তার ওযূ হয় না।’ (সহীহ আবূ দাউদ ৯১, সুনান আবূ দাউদ, ১০২, সহীহ ইবনু মাজাহ ৩১৮, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৯৭, সুনান তিরমিযী ২৫, সুনান দারাকুতনী ৩, সুনান দারিমী ৬৯১, মুসনাদ আহমাদ ১১৩৭০, ১১৩৭১, মুসতাদরাক হাকিম ৫১৮, ৫১৯, ৫২০, হাদীস সহীহ) এ হাদীসটি হাসান বা উত্তম। কোন কোন ‘আলিম তো ওযূর সময় বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব বলে থাকেন। আবার কেউ সর্বকাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব বলেছেন। প্রাণী যবেহ করার সময়েও বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। ইমাম শাফি‘ঈ সহ একটি দলের মত এটাই। কেউ কেউ যিকিরের সময় এবং কেউ কেউ সাধারণভাবে একে ওয়াজিব বলে থাকেন। এর বিশদ বর্ণনা ইনশা’আল্লাহ আবার অতি সত্বরই আসবে। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে এই আয়াতটির ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁর মধ্যে একটি হলো, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তুমি যখন স্ত্রী মিলনের ইচ্ছা করবে, তখন বিসমিল্লাহ বলে নিয়ো। কেননা এই মিলনের পর তোমাকে যদি সন্তান দেয়া হয়, তাহলে তার নিজের ও তার সমস্ত ঔরসজাত সন্তানের নিঃশ্বাসের সংখ্যার সমান পুণ্য তোমার ‘আমলনামায় লেখা হবে। অবশ্য এর কোন মূলভিত্তি নেই। আমি নির্ভরযোগ্য কোন কিতাবে এবং এমনকি অন্য কোন কিতাবেও এটা পাইনি। খাওয়ার সময়ে বিসমিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। সহীহ মুসলিমে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘উমার ইবনু আবী সালামাহ (রাঃ)-কে অর্থাৎ যিনি তাঁর সহধর্মিনী উম্মু সালামাহ্ (রাঃ)-এর পূর্ব স্বামীর পুত্র ছিলেন তিনি বলেনঃ قُلْ بِاسْمِ اللهِ وَكُلْ بِيَمِينِكَ وَكُلْ مِمَّا يَلِيكَ ‘বিসমিল্লাহ বলো, ডান হাতে খাও এবং তোমার সামনের দিক থেকে খেতে থাকো।’ (সহীহ মুসলিম ৩/১০৮, ১৫৯৯, ১৬০০, সুনান আবূ দাউদ ৩/৩৭৭৭, জামি‘উত তিরমিযী ৪/১৮৫৭, সুনান ইবনু মাজাহ ১/৩২৬৭, মুসনাদ আহমাদ ৪/ ২৬, ২৭, ৪৫, ৪৬, ৫০, হাদীস সহীহ) কোন কোন ‘আলিম এ সময়েও ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ওয়াজিব বলে থাকেন। স্ত্রীর সাথে মিলনের সময়েও ‘বিসমিল্লাহ’ বলা মুস্তাহাব। সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ স্বীয় স্ত্রীর সাথে মিলনের ইচ্ছা করলে সে যেন এটা পাঠ করেঃ بِسْمِ اللهِ اَللّٰهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَارَزَقْتَنَا. ‘মহান আল্লাহর নামের সাথে আরম্ভ করছি। হে মহান আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এবং যা আমাদেরকে দান করবেন তাকেও শায়তানের কবল থেকে রক্ষা করুন।’ তিনি আরো বলেন যে, এই মিলনের ফলে যদি সে গর্ভধারণ করে তাহলে শায়তান সেই সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (ফাতহুল বারী ৯/১৩৬, সহীহুল বুখারী, ৬/৩২৮৩, সহীহ মুসলিম ৩/১১৬, ১০৫৮, সুনান আবূ দাউদ ২/২১৬১, সুনান তিরমিযী ৩/১০৯২, সুনান ইবনু মাজাহ ১/১৯১৯, মুসনাদ আহমাদ১/২৮৬, হাদীস সহীহ) এখান থেকে স্পষ্ট হলো যে, বিসমিল্লাহ এর ب এর সম্পর্ক কার সাথে রয়েছে। ব্যাকরণগত শব্দ বিন্যাস বিসমিল্লাহ এর ب এর সম্পর্ক اسم এর সাথে না فعل এর সাথে তা নির্ণয়ে ব্যাকরণবিদগণের পক্ষ থেকে দু’টি মত রয়েছে। তবে মত দু’টি একটি অন্যটির কাছাকাছি। প্রত্যেকে স্বীয় মতের পক্ষে কুর’আন থেকেই যুক্তি দেখিয়েছেন। সুতরাং যারা اسم কে উহ্য মানেন, তাদের মতে উহ্য ‘ইবারত হবে باسم الله ابتدائي অর্থাৎ আমার শুরু মহান আল্লাহর নামের সাথে। তাদের দালীল মহান আল্লাহর বাণীঃ ﴿ارْكَبُوْا فِیْهَا بِسْمِ اللّٰهِ مَجْرىهَا وَمُرْسٰىهَا اِنَّ رَبِّیْ لَغَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ﴾ ‘এতে আরোহণ করো, মহান আল্লাহর নামে এর গতি ও এর স্থিতি। আমার প্রতিপালক অবশ্যই বড়ই ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু।’ (১১ নং সূরাহ হুদ, আয়াত-৪১) এ আয়াতে اسم তথা مصدر উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। আর যারা فعل কে উহ্য মানেন, তাদের দালীলঃ اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَق ‘পাঠ করো তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (৯৬ নং সূরাহ আল ‘আলাক, আয়াত ১) তবে উভয়টি সঠিক। কেননা فعل এর জন্যেও مصدر আবশ্যক। অতএব فعل বা مصدر এর যে কোন একটি উহ্য মানার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রয়েছে। অতএব যে مصدر কে فعل বা ক্রিয়া অনুপাতে নিয়ে আসা হবে। দাঁড়ানো, বসা, খানাপিনা, কুর’আন পাঠ, ওযূ ও সালাত যা-ই হোক কেন এগুলোর শুরুতে বরকত, কল্যাণ, ও সাহায্য প্রার্থনার উদ্দেশ্যে এবং তা যাতে মঞ্জুর হয় সে জন্য মহান আল্লাহর নাম নেয়া ইসলামী শারী‘আতের একটি অন্যতম বিধান। মহান আল্লাহই এসব বিষয়ে ভালো জানেন। তাইতো ইবন ও ইবনু আবী হাতিম (রহঃ) নিজ নিজ তাফসীর গ্রন্থে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, নিশ্চয় জিবরাইল (আঃ) সর্বপ্রথম যে বিধানটি মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর অবতীর্ণ করেন তা হলো, ‘হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলুন, أَسْتَعِيذُ بِالسَّمِيعِ الْعَلِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ অর্থাৎ আমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানীর নিকট বিতাড়িত শায়তানের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আবার বললো আপনি বলুন, بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ অর্থাৎ পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি। বর্ণনাকারী ইবনু ‘আব্বাস বলেন, জিবরাঈল (আঃ) বললো, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তুমি বিসমিল্লাহ বলো। উদ্দেশ্য ছিলো যেন উঠা, বসা, পড়া, খাওয়া সব কিছুই আল্লাহর নামে শুরু হয়। (তাফসীর তাবারী, প্রথম খণ্ড, হাদীস ১৩৯, হাদীস য‘ঈফ) اسم শব্দের বিশ্লেষণ اسم অর্থাৎ নামটাই কি মুসাম্মা তথা নাম যুক্ত না অন্য কিছু। এ ক্ষেত্রে মনিষীগণের মাঝে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। একঃ নামটাই হচ্ছে মুসাম্মা বা নামযুক্ত। আবূ ‘উবাইদা এবং সিবাওয়াইয়ের মত এটাই। বাকিল্লানী ও ইবনু ফরুকও এমতটি পছন্দ করেন। মুহাম্মাদ ইবনু ‘উমার ইবনু খাতীব রাযী স্বীয় তাফসীরের সূচনায় লিখেছেনঃ ‘হাসভিয়্যাহ, (শি‘আ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হিশামীদের মতো মহান আল্লাহর জন্য তাসবীহ সাব্যস্তকারী একটি সম্প্রদায়, তারা বলে ‘তাদের মা‘বূদ হচ্ছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশিষ্ট একটি আকার সম্পন্ন সত্তা। সেটা রূহানী অথবা দৈহিক হতে পারে। তার জন্য স্থানান্তরিত হওয়া, অবতরণ করা, ওপরে উঠা, স্থির থাকা সবই সাব্যস্ত করে। (আল মিলাল ওয়াল মিনহাল ১/১১২)) কারামিয়্যাহ (তারা আবূ ‘আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু কাররাম এর অনুসারীগণ। তিনি মহান আল্লাহর জন্য সিফাত তথা গুণ সাব্যস্ত করতেন তবে তা শরীর এর মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করেন। আর মহান আল্লাহর জন্য তাশবীহ সাব্যস্ত করেন। (আল মিলাল ওয়াল মিনহাল ১/১১৫)) ও আশ‘আরীগণ (আবুল হাসান ‘আলী ইবনু ইসমা‘ঈল আল আশ‘আরীর অনুসারীগণ। (আল মিলাল ওয়াল মিনহাল ১/৯৭) বলেন যে, اسم হলো نفس مسمى কিন্তু نفس تسمية হতে আলাদা। আর মু‘তাযিলাগণ (তারা বলে যে, কুর’আন মাখলূক, (আল মিলাল ওয়াল মিনহাল ১/৫০, ৫১) বলেন যে, اسم হলো نفس تسمية কিন্তু نفس مسمى হতে পৃথক। আমাদের মতে اسم টি مسمى ও غير مسمى দু’টো থেকেই আলাদা। আমরা বলি যে, যদি اسم এর উদ্দেশ্য لفظ হয় যা শব্দ সমূহের অংশ বা অক্ষরসমূহের সমষ্টি, তাহলে এটা অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সাব্যস্ত হয় যে, এটা مسمى হতে পৃথক। আর যদি اسم হতে উদ্দেশ্য হয় ذات مسمى তাহলে এটা হবে একটি স্পষ্টকে স্পষ্ট করার কাজ যা শুধু নিরর্থক ও বাজে কাজেরই নামান্তর। সুতরাং এটা স্পষ্ট কথা যে, বাজে আলোচনায় সময়ের অপচয় একটা নিছক অনর্থক কাজ। অতঃপর اسم ও مسمى কে পৃথকীকরণের ওপর দালীল প্রমাণ আনা হয়েছে যে, কখনো اسم হয় কিন্তু مسمى হয় না। যেমন معدوم বা অস্তিত্বহীন শব্দটি। কখনও আবার একটি مسمى কয়েকটি اسم হয়। যেমন مترادف বা সমার্থবোধক শব্দ। আবার কখনো اسم একটি হয় এবং مسمى হয় কয়েকটি। যেমন مشترك, সুতরাং বোঝা গেলো যে, اسم ও مسمى এক জিনিস নয়। অর্থাৎ নাম এক জিনিস আর মুসাম্মা বা নামধারী অন্য জিনিস। কারণ যদি اسم কেই مسمى ধরা হয়, তবে আগুনের নাম নেয়া মাত্রই তার দাহন ও গরম অনুভূত হওয়া উচিৎ। আর বরফের নাম নিলেই ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়া দরকার। অথচ কোন জ্ঞানীই একথা বলেন না। আর বলতেও পারেন না। এর দালীল প্রমাণ এই যে, আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ রয়েছে, وَللهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا ‘মহান আল্লাহর অনেক সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, তোমরা ঐসব নাম দ্বারা আল্লাহকে ডাকতে থাকো।’ (৭ নং সূরাহ আল আ‘রাফ, আয়াত ১৮০) আর হাদীসে আছেঃ إِنَّ للهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا ‘আল্লাহ তা‘আলার ৯৯টি নাম আছে।’(সহীহুল বুখারী ২৫৮৫, ৬৯৫৭, সহীহ মুসলিম ৬৯৮৬, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৮৬০, ৩৮৬১, সুনান তিরমিযী ৩৫০৬, ৩৫০৮, মুসনাদ আহমাদ, ৭৫০২, ৭৬২৩, হাদীস সহীহ) তাহলে চিন্তার বিষয় যে, নাম কতো বেশি আছে। অথচ مسمى একটিই। আর তিনি হলেন অংশীবিহীন অদ্বিতীয় মহান আল্লাহ। এরকমই اسماء কে এ আয়াতে الله এর দিকে সম্বন্ধ লাগানো হয়েছে। মহান আল্লাহ অন্য এক জায়গায় বলেছেনঃ فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ ‘কাজেই তুমি তোমার মহান প্রতিপালকের গৌরব ও মহিমা ঘোষণা করো।’ (৬৯ সূরাহ আল হাক্কাহ, আয়াত ৫২) ইত্যাদি। اضافت ও এটাই চায় যে, اسم ও مسمى অর্থাৎ নাম ও নামধারী ভিন্ন জিনিস। কারণ إضافة দ্বারা সম্পূর্ণ অন্য এক বিরোধী বস্তুকে বুঝায়। এরকমই মহান আল্লাহর উপরোক্ত নির্দেশঃ فادعوه بها অর্থাৎ মহান আল্লাহকে তাঁর নামসমূহ দ্বারাই ডাকো। এটাও এ বিষয়ের দালীল প্রমাণ যে, নাম এক জিনিস আর নামধারী ভিন্ন জিনিস। অতএব যারা اسم ও مسمى কে এক বলেন তাদের দালীল এই যে, মহান আল্লাহ বলেনঃ تَبَارَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِي الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ ‘ক্ষমতা, দয়ামায়া ও সম্মানের অধিকারী তোমার প্রতিপালকের নাম বড়ই কল্যাণময়।’ (৫৫ নং সূরাহ আর রাহমান, আয়াত-৭৮) এখানে নামকে কল্যাণময় ও মর্যাদাসম্পন্ন বলা হয়েছে, অথচ স্বয়ং আল্লাহই কল্যাণময়। এর সহজ উত্তর এই যে, সেই পবিত্র প্রভুর কারণেই তাঁর নামও শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ হয়েছে। তাদের দ্বিতীয় দালীল এই যে, যখন কেউ বলে ‘যায়নাবের ওপর তালাক’ তখন শুধু সেই ব্যক্তির ঐ স্ত্রীর ওপরই তালাক হয়ে থাকে যার নাম যায়নাব। যদি নাম ও নামধারীর মধ্যে পার্থক্য থাকতো তবে শুধু নামের ওপরই তালাক পড়তো, নামধারীর ওপর কি করে পড়তো? এর উত্তর এই যে, এ কথার ভাবার্থ এই রূপ যে, যার নাম যায়নাব তার ওপর তালাক। تسمية এর اسم হতে ভিন্ন হওয়া এই দালীল এর ওপর ভিত্তি করে যে, تسمية বলা হয় কারো নাম নির্ধারণ করাকে। আর এটা সুস্পষ্ট কথা যে, এটা এক জিনিস এবং নামধারী অন্য জিনিস। ইমাম রাযী (রহঃ)-এরও কথা এটাই। এই সবকিছু باسم এর সম্পর্কে আলোচনা ছিলো। এখন الله শব্দ সম্পর্কে আলোচনা শুরু হচ্ছে। ‘আল্লাহ’ শব্দের অর্থ اَللهُ বরকত বিশিষ্ট ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মহান প্রভুর একটি বিশিষ্ট নাম। বলা হয় যে, এটাই إِسْمِ اَعْظَم কেননা সমুদয় উত্তম গুণের সাথে এটাই গুণান্বিত হয়ে থাকে। যেমন পবিত্র কুর’আনে ইরশাদ হচ্ছেঃ ﴿هُوَ اللّٰهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ١ۚ عٰلِمُ الْغَیْبِ وَ الشَّهَادَةِ١ۚ هُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِیْمُ۝۲۲ هُوَ اللّٰهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ١ۚ اَلْمَلِكُ الْقُدُّوْسُ السَّلٰمُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَیْمِنُ الْعَزِیْزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ١ؕ سُبْحٰنَ اللّٰهِ عَمَّا یُشْرِكُوْنَ۝۲۳ هُوَ اللّٰهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰى١ؕ یُسَبِّحُ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ١ۚ وَهُوَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ﴾ তিনিই মহান আল্লাহ, তিনি ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই, তিনি অদৃশ্য এবং দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা; তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। তিনিই মহান আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই। তিনিই অধিপতি, তিনিই পবিত্র, তিনিই শান্তি, তিনিই নিরাপত্তা বিধায়ক, তিনিই রক্ষক, তিনিই পরাক্রমশালী, তিনিই প্রবল, তিনিই অতীব মহিমাম্বিত; যারা তাঁর শরীক স্থির করে মহান আল্লাহ তা থেকে পবিত্র ও মহান। তিনিই মহান আল্লাহ, সৃজনকর্তা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, সকল উত্তম নাম তাঁরই। আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (৫৯ নং সূরাহ্ হাশর, আয়াত নং ২২-২৪) এ আয়াতসমূহে ‘আল্লাহ’ ব্যতীত অন্যান্য সবগুলোই গুণবাচক নাম এবং এগুলো ‘আল্লাহ’ শব্দেরই বিশেষণ। সুতরাং মূল ও প্রকৃত নাম ‘আল্লাহ’। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেনঃ ﴿وَ لِلّٰهِ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰى فَادْعُوْهُ بِهَا﴾ আর মহান আল্লাহর জন্য সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে, সুতরাং তোমরা তাঁকে সেই সব নামেই ডাকবে। (৭ নং সূরাহ্ আ‘রাফ, আয়াত নং ১৮০) অপর আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ ﴿ قُلِ ادْعُوا اللّٰهَ اَوِ ادْعُوا الرَّحْمٰنَ اَیًّا مَّا تَدْعُوْا فَلَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰى ﴾ ‘বলো! তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহ্বান করো অথবা ‘রাহমান’ নামে আহ্বান করো, তোমরা যে নামেই আহ্বান করো না কেন, সব সুন্দর নামই তো তাঁর!’ (১৭ নং সূরাহ্ ইসরাহ, আয়াত নং ১১০) সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ إِنَّ لِلهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلاَّ وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মহান আল্লাহ্‌র নিরানব্বই অর্থাৎ এক কম একশ’টি নাম রয়েছে, যে ব্যক্তি তা মনে রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহীহুল বুখারী হাঃ ২/২৭৩৬, ৬৪১০, ৭৩৯২, সহীহ মুসলিম ৪৮/২ হাঃ ২৬৭৭, মুসনাদ আহমাদ হাঃ ৭৫০৫, আ.প্র. হাঃ ২৫৩৪, ই.ফা. হাঃ ২৫৪৬। মাকতাবে শামিলাহ: সহীহুল বুখারী ২৫৮৫, ৬৯৫৭, সহীহ মুসলিম ৬৯৮৬, সুনান ইবনু মাজাহ ৩৮৬০, ৩৮৬১, সুনান তিরমিযী ৩৫০৬, ৩৫০৮, মুসনাদ আহমাদ, ৭৫০২, ৭৬২৩, হাদীস সহীহ) ‘জামি‘উত তিরমিযী ও সুনান ইবনু মাজায় নামগুলো এসেছে। (হাদীসটি সহীহ। জামি‘ তিরমিযী ৯/৪৮০, সুনান ইবনু মাজাহ ২/২১৬৯) এ দু’হাদীস গ্রন্থের বর্ণনায় শব্দের কিছু পার্থক্য আছে এবং সংখ্যায় কিছু কম-বেশি রয়েছে। ‘আর রাহমানির রাহীম’-এর অর্থ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ শব্দ দু’টিকে رَحْمَتْ থেকে নেয়া হয়েছে। অর্থের দিক দিয়ে দু’টির মধ্যেই ‘মুবালাগাহ’ বা আধিক্য রয়েছে, তবে ‘রাহীমের’ চেয়ে ‘রাহমানের’ মধ্যে আধিক্য বেশি আছে। ‘আল্লামাহ্ ইবনু জারীর (রহঃ)-এর কথা অনুযায়ী জানা যায় যে, এতে প্রায় সবাই একমত। পূর্ববর্তী যুগের সালফি সালিহীন ‘ঈসা (আঃ)-এর সূত্রে বলেন যা ইতোপূবেই উল্লিখিত হয়েছে যে, রাহমানের অর্থ হলো দুনিয়া ও আখিরাতে দয়া প্রদর্শনকারী এবং রাহীমের অর্থ শুধু আখিরাতে রহমকারী। কেউ কেউ বলেন যে, رَحْمَن শব্দটি مُشْتَق নয়। কারণ যদি তা এ রকমই হতো তাহলে مَرْحُوْم-এর সাথে মিলে যেতো। অথচ কুর’আনুল কারীমের মধ্যে রয়েছেঃ ﴿ وَ كَانَ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَحِیْمًا ﴾ আর তিনি মু’মিনদের প্রতি পরম দয়ালু। (৩৩ নং সূরাহ্ আহযাব, আয়াত নং ৪৩) ইবনুল ‘আরবী মুবাররাদের সূত্রে বলেছেন যে, رحمن হচ্ছে ‘ইবরানী নাম, ‘আরবী নয়। আর আবূ ইসহাক আয-যুজাজ معاني القرآن নামক গ্রন্থে আহমাদ ইবনু ইয়াহ্ইয়া (রহঃ)-এর উক্তি উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি বলেছেন الرحيم ‘আরবী, আর الرحمن ‘ইবরানী নাম। আর এই জন্য উভয়টিকে একত্রিত করা হয়েছে। কিন্তু আবূ ইসহাক বলেন, এ কথাটি غير مرغوب তথা অপছন্দনীয়। ইমাম কুরতবী (রহঃ) এ শব্দটিকে مشتق বলেছেন। তিনি দালীল হিসেবে জামি‘ তিরমিযী বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করেছেন এবং তা সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর তা হলো ‘আবদুর রহমান ইবনু ‘আউফ (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছেন, মহান আল্লাহ বলেনঃ أَنَا الرَّحْمَنُ خَلَقْتُ الرَّحِمَ وَشَقَقْتُ لَهَا اسْمًا مِنَ اسْمِى فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ وَمَنْ قَطَعَهَا بَتَتُّهُ আমিই আর-রাহমান, আমি রাহম সৃষ্টি করেছি এবং আমার নাম থেকেই রাহীম নামের সৃষ্টি। অতএব, যে এর হিফাযত করে, আমি তার সাথে সম্পর্ক অটুট রাখি এবং যে ছিন্ন করে আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করি। (জামি‘ তিরমিযী ৪/১৯০৭, সুনান আবূ দাউদ ২/১৬৯৪, মুসনাদ আহমাদ ২/৪৯৮, মুসতাদরাক হাকিম ৪/১৫৭, সুনান বায়হাকী ১২৯৯৪, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪৪৩, হাদীস সহীহ) তিনি বলেন, এটা হলো الرحمن শব্দটি مشتق হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ। অতএব প্রকাশ্য হাদীসের বিরোধিতা ও অস্বীকার করার কোন উপায় বা অবকাশ নেই। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞতা, মূর্খতা ও বোকামীর কারণেই আরবগণ الرحمن নামকে অস্বীকার করে। কুরতবী (রহঃ) বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, এ শব্দ দু’টি ندمان ও نديم এর ন্যায় একই অর্থবোধক। আবূ ‘উবাইদ এমন কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ এটাও বলেছেন যে, فَعْلان শব্দটি فعيل এর মতো নয়। কেননা فعلان শব্দটি অত্যাবশ্যকীয়ভাবে ক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার আধিক্যতার প্রতি প্রমাণ করে। যেমন কারো উক্তি- رجل غضبان তথা লোকটি খুবই রাগান্নিত। এটা তখনই বলা হয়, যখন সে পূর্ণ রাগান্বিত হয়। আর فعيل এর ওযনটি কখনো কখনো কর্তা ও কর্ম উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়, যাতে আধিক্যতার প্রতি প্রমাণ থাকে না। আবূ ‘আলী ফারসী (রহঃ) বলেন যে, الرحمن মহান আল্লাহর সাথে নির্ধারিত রহমতের সকল প্রকারকে অন্তর্ভুক্তকারী একটি ব্যাপক অর্থবোধক নাম। আর الرحيم শুধু মু’মিন তথা বিশ্বাসীদের সাথে নির্ধারিত নাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ كَانَ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَحِیْمًا ‘আর তিনি মু’মিনদের প্রতি পরম দয়ালু।’ (৩৩ নং সূরাহ্ আহযাব, আয়াত নং ৪৩) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, هُمَا اِسْمَانِ رَقِيْقَانِ أَحَدُهُمَا أَرَقُّ مِنَ الْآخَرِ ‘এই দু’টি নামই করুণা ও দয়া বিশিষ্ট। একের মধ্যে অন্যের তুলনায় দয়া ও করুণা বেশি আছে।’ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর এ বর্ণনায় أَرَقُّ শব্দের জটিলতা নিরসনে খাত্তাবী ও অন্যান্যরা বলেছেন হয়তো أرق দ্বারা أرفق উদ্দেশ্য। যেমন হাদীসে রয়েছেঃ إِنَّ اللهَ رَفِيقٌ يُحِبُّ الرِّفْقَ وَيُعْطِى عَلَى الرِّفْقِ مَا لاَ يُعْطِى عَلَى الْعُنْفِ. নিশ্চয় মহান আল্লাহ দয়ালু, তিনি দয়া করাকে পছন্দ করেন। নিতি নম্রতা ও দয়ার কারণে এমন নি‘য়ামত দান করেন যা কঠোরতার কারণে দেন না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস- ৬৭৬৬, বাকী অংশ হলো, وَمَا لَا يُعْطِى عَلَى مَا سِوَاهُ। মুসনাদ আহমাদ ১/১১২ পৃষ্ঠা, সুনান আবূ দাউদ ৪/৪৮০৭, সুনান বায়হাকী ১০/১৯৩, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ২/৬৭৯, হাদীস ৩৮, মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ ৮/১৮ পৃষ্ঠা। হাদীস সহীহ) আর ইবনুল মুবারক বলেন, الرحمن হলো, যার কাছে চাওয়া হলে তিনি দান করেন। আর الرحيم হলো যার কাছে প্রার্থনা না করলে তিনি ক্রোধান্নিত হোন। আর এর স্বপক্ষে জামি‘ তিরমিযী ও ইবনু মাজাতে বর্ণিত হাদীস প্রমাণ যোগ্য, যা আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ مَنْ لَمْ يَسْألِ اللهَ يَغضَبْ عَلَيْهِ অর্থাৎ যে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে না, মহান আল্লাহ তার প্রতি রাগান্নিত হোন। (জামি‘ তিরমিযী, হাদীস- ৫/৩৩৭৩, ইবনু মাজাহ ২/৩৮২৮, হাদীস সহীহ) কোন একজন কবি বলেছেনঃ لا تطلبن بني آدم حاجة ... وسل الذي أبوابه لا تغلق الله يغضب إن تركت سؤاله ... وبني آدم حين يسأل يغضب তুমি আদম সন্তানের কাছে প্রয়োজন পূরণের কামনা করো না, বরং তাঁর কাছে চাও, যার দরজা কখনো বন্ধ করা হয় না। মহান আল্লাহ ক্রোধান্নিত হোন যদি তুমি তাঁর কাছে চাওয়া বর্জন করো, আর আদম সন্তান রাগান্নিত হয় তার কাছে চাওয়া হয়। ইবনু জারীর (রাঃ) আযরামী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, রাহমানের অর্থ হলো যিনি সমুদয় সৃষ্ট জীবের প্রতি করুণা বর্ষণকারী। আর রাহীমের অর্থ হলো যিনি মু’মিনদের ওপর দয়া বর্ষণকারী। (তাফসীর তাবারী ১/ ১০৩ হাদীস ১৪৬, হাদীস য‘ঈফ) যেমন কুর’আনুল হাকীমের নিম্নের দু’টি আয়াতে রয়েছেঃ তারপর তিনি ‘আরশে সমাসীন হোন। (২৫ নং সূরাহ্ ফুরকান, আয়াত নং ৫৯) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ ﴿ ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ١ۛۚ اَلرَّحْمٰنُ ﴾ ﴿اَلرَّحْمٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى﴾ দয়াময় ‘আরশে সমাসীন। (২০ নং সূরাহ্ তা-হা, আয়াত নং ৫) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বর্ণনা করেন যে, তিনি তাঁর আর-রাহমান’ নামসহ ‘আরশে অবস্থান করতেন এবং তার সকল সৃষ্টিকে তাঁর দয়া ও রহমত ঘিরে রেখেছে। তিনি অন্যত্র আরো বলেনঃ ﴿وَ كَانَ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَحِیْمًا﴾ আর তিনি মু’মিনদের প্রতি পরম দয়ালু। (৩৩ নং সূরাহ্ আহযাব, আয়াত নং ৪৩) সুতরাং জানা গেলো যে, رَحْمَن-এর মধ্যে رَحِيْم-এর তুলনায় مُبَالَغَة অনেক গুণ বেশি আছে। (তাফসীর কুরতুবী ১/১০৫) কিন্তু হাদীসের একটি দু‘আর মধ্যে رَحْمَنُ الدُّنْيَا وَالْأَخِرَةِ وَرَحِيْمَهُمَا এভাবেও এসেছে। ‘রাহমান’ নামটি আল্লাহ তা‘আলার জন্যই নির্ধারিত। তিনি ছাড়া আর কারো এ নাম হতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ রয়েছেঃ ﴿قُلِ ادْعُوا اللّٰهَ اَوِ ادْعُوا الرَّحْمٰنَ١ؕ اَیًّا مَّا تَدْعُوْا فَلَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰى﴾ বলো! তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহ্বান করো অথবা ‘রাহমান’ নামে আহ্বান করো, তোমরা যে নামেই আহ্বান করো না কেন, সব সুন্দর নামই তো তাঁর! (১৭ নং সূরাহ্ ইসরাহ, আয়াত নং ১১০) অন্য একটি আয়াতে আছেঃ ﴿وَاسْـَٔلْ مَنْ اَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُّسُلِنَاۤ اَجَعَلْنَا مِنْ دُوْنِ الرَّحْمٰنِ اٰلِهَةً یُّعْبَدُوْنَ﴾ ‘তোমার পূর্বে আমি যে সব রাসূল প্রেরণ করেছিলাম তাদেরকে তুমি জিজ্ঞেস করো, আমি কি দয়মায় মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন দেবতা স্থির করেছিলাম, যার ‘ইবাদত করা যায়? (৪৩ নং সূরাহ্ যুখরুফ, আয়াত নং ৪৫) মুসাইলামাতুল কায্যাব যখন নাবুওয়াতের দাবী করে এবং নিজেকে ‘রাহমানুল ইয়ামামা’ নামে দাবী করে, আল্লাহ তা‘আলা তখন তাকে অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত করেন এবং চরম মিথ্যাবাদী নামে সে সারা দেশে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। আজও তাকে মুসাইলামা কায্যাব বলা হয় এবং প্রত্যেক মিথ্যা দাবীদারকে তার সাথে তুলনা করা হয়। আজ প্রত্যেক পল্লীবাসী ও শহরবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত আবালবৃদ্ধ সবাই তাকে মিথ্যাবাদী বলে জানে। কোন কোন বিদ্ব্যান মনে করেন যে, الرحمن এর চেয়ে الرحيم এর মধ্যেই অর্থের আধিক্যতা বেশি রয়েছে। কেননা এ শব্দের সাথে পূর্বের শব্দের তাকিদ করা হয়েছে। আর যার তাকিদ করা হয়, তা অপেক্ষা তাকিদই বেশি জোরদার হয়ে থাকে। এর উত্তর এই যে, এটাতো তাকিদই হয় না, বরং এটা একটি نَعْتٌ তথা গুণবাচক বিশেষ্য। সুতরাং উপরোক্ত কোন বিষয়ই এর মধ্যে আবশ্যক করবে না। আর এরই ভিত্তিতে বলা হবে যে, ‘আল্লাহ’ নামটি অগ্রগামী করা হয়েছে যার পূর্বে এমন নাম তিনি ছাড়া আর কেউ রাখেনি। আর ‘রাহমান’ সিফত প্রথমে এনে উক্ত নাম অন্য কারো রাখাকে নিষেধ করছে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ ﴿قُلِ ادْعُوا اللّٰهَ اَوِ ادْعُوا الرَّحْمٰنَ١ؕ اَیًّا مَّا تَدْعُوْا فَلَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰى﴾ ‘বলো! তোমরা ‘মহান আল্লাহ’ নামে আহ্বান করো অথবা ‘রাহমান’ নামে আহ্বান করো, তোমরা যে নামেই আহ্বান করো না কেন, সব সুন্দর নামই তো তাঁর!’ (১৭ নং সূরাহ্ ইসরাহ, আয়াত নং ১১০) মুসাইলামাতুল কায্যাব এ জঘন্যতম স্পর্ধা দেখালেও সে সমূলে ধ্বংস হয়েছিলো এবং তার ভ্রষ্ট সাথীদের ছাড়া এটা অন্যের ওপর চালু হয়নি। ‘রাহীম’ বিশেষণটির সাথে আল্লাহ তা‘আলা অন্যদেরকেও বিশেষিত করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ ‘তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের নিকট একজন রাসূল এসেছেন, তোমাদের যা কিছু কষ্ট দেয় তা তার নিকট খুবই কষ্টদায়ক। সে তোমাদের কল্যাণকামী, মু’মিনদের প্রতি করুণাসিক্ত, বড়ই দয়ালু।’ (৯ নং সূরাহ্ তাওবাহ, আয়াত নং ১২৮) এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে رحيمٌ বলেছেন। এভাবেই তিনি স্বীয় কতোগুলো নাম দ্বারা অন্যদেরকে স্মরণ করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ ﴿اِنَّا خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ اَمْشَاجٍۖۗ نَّبْتَلِیْهِ فَجَعَلْنٰهُ سَمِیْعًۢا بَصِیْرًا﴾ আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুত্র’বিন্দু থেকে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য; এ জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন। (৭৬ নং সূরাহ্ আদ্ দাহর, আয়াত নং ২) এখানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে سَمِيْعٌ ও بَصِيْرٌ বলেছেন। মোট কথা এই যে, মহান আল্লাহর কতোগুলো নাম এমন রয়েছে যেগুলোর প্রয়োগ ও ব্যবহার অন্য অর্থে অন্যের ওপরও হতে পারে এবং কতোগুলো নাম আবার মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ওপর ব্যবহৃত হতেই পারে না। যেমন আল্লাহ, রাহমান, খালিক, রাযিক ইত্যাদি। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা প্রথম নাম নিয়েছেন ‘আল্লাহ’, তারপর এর বিশেষণ রূপে ‘রাহমান’ এনেছেন। কেননা, ‘রাহীমের’ তুলনায় এর বিশেষত্ব ও প্রসিদ্ধি অনেক গুণ বেশি। মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম তাঁর সবচেয়ে বিশিষ্ট নাম নিয়েছেন, কেননা নিয়ম রয়েছে সর্বপ্রথম সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন নাম নেয়া। তারপর তিনি তুলনামূলকভাবে স্বল্প মানের ও নিম্ন মানের এবং তারও পরে তদপেক্ষা কম টা নিয়েছেন। একটি জিজ্ঞাসা ও তার জবাব যদি বলা হয়, যেহেতু الرحمن শব্দটি অর্থের অনেক আধিক্যতা রাখে, সুতরাং الرحيم না বলে শুধু রাহমানের ওপর যথেষ্ট বা ক্ষ্যান্ত করা হলো না কেন? তাহলে এর জবাব হলো ‘আতা খুরাসানি কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি। যার ভাবার্থ হলো যেহেতু মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামও রাহমান রাখা হয়, তাই الرحيم নিয়ে আসা হয়েছে যাতে সংশয় কেটে যায়। কেননা الرحمن ও الرحيم শব্দ দু’টি আল্লাহ তা

    ﴾   بِسۡمِ اللّٰہِ الرَّحۡمٰنِ الرَّحِیۡمِ   ﴿ সূরা ফতিহার তাফসির ৷৷ তাফসিরে ইবনে কাসির ৷৷ পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ্‌র নামে শু...